RSS

Wednesday, June 10, 2009

প্রকৃতির কাছাকাছি


নগর থেকে নগরে এখন শুধুই ভিড় বাড়ে ইমারতের। নগর জীবনে, নাগরিক মন ও মননে চোখ মেলে দেখা হয় না জারুল, কৃষ্ণচূড়ার আগুন ধরা প্রকৃতির রঙ। ব্যস্ত রাস্তায়, কার্বনের বিষে ভুলে যেতে হয় মাটির ঘ্রাণটুকুও। তবু প্রকৃতিকে ভালোবেসে যারা এখনো বাঁচতে চান আরো কিছুদিন তারা এই ইট-কাঠের শহরেও খুঁজে ফেরেন সবুজের সান্নিধ্য। শহরের একটুকরো সবুজের মাঝে পেতে চান প্রকৃতির বিশালতাকে। কিন্তু যে প্রকৃতির সন্তান হয়ে এই পৃথিবীতে যাত্রা শুরু মানুষের সেই প্রকৃতিই যেন আজ মরতে বসেছে সভ্যতার উগ্র বিকাশে। সামান্য কিছু সচেতনতার অভাবে পরিবেশ আর প্রকৃতির দূষণও এগিয়ে চলছে মহামারীর দিকে। পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে ‘কড়চা’র এবারের মূলফিচার লিখেছেন রাশেদুল হাসান শুভ

বাড়ির গৃহপরিচারিকা যাচ্ছেন ময়লা ফেলতে। এমন সময় পেছন থেকে বাড়ির কর্তা অনেকটা হাঁক দিয়েই বললেন ‘আমাদের গেট থেকে একটু দূরে নিয়ে ময়লাটা ফেলিস। নাহলে দূর্গন্ধে টেকা দায় হবে’। ভাবটা এমন যে নিজের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে ময়লা ফেলতে পারাটাই যেন স্বার্থকতা। অন্যের তাতে সমস্যা হলো কি না কিংবা পরিবেশের তাতে কোনো ক্ষতি হলো কিনা অতটা ভাবতে বয়েই গেছে। কিন্তু আজ যিনি দিব্যি বাবুগিরি করে ঘরে বসে বাইরের বারোটা বাজাচ্ছেন কাল তার উত্তর প্রজন্ম একটা বাসযোগ্য পৃথিবী পাবে তো? কিংবা নীল আকাশের নীচে এক চিলতে সবুজ ঘাসের মাঠে কখনো কি পা রাখা হবে তার? আয়েশী আর যান্ত্রিক জীবনের অন্য সব ভাবনার পাশাপাশি এ ভাবনাটাও যে এখন বড্ড জরুরী।

‘আমরা ও আমাদের চারপাশের যা কিছু তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ’। সেই ছোট্টবেলায় প্রাথমিক পাঠের গন্ডিতেই পরিবেশের সাথে আমাদের প্রথম পরিচয়। অথচ সময় গড়িয়ে ছোট থেকে বড় হবার মাঝেই আমার বেমালুম হারিয়ে ফেলেছি পরিবেশের ভাবনাকে। তাই আমাদের চারপাশের যা কিছুর তালিকায় এখন শুধুই সারি সারি ইমারত। সেখানে গাছ নেই, নদী নেই, নেই বুকভরে শ্বাস নেবার মতো বাতাসও। জনসংখ্যার চাপে থাকা একটি দেশের জন্য হয়তো এটি নতুন কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে প্রকৃতিকে ভুলে গেলে চলবে কেন? বরং নিজের ছোট্ট গৃহকোণে আর বাড়ির সামনে মিলে যাওয়া এক চিলতে উঠোনেও ধারণ করতে হবে প্রকৃতির মিনিয়েচারকে। অন্যদিকে ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসা যে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা তাকেও রাখতে হবে বাঁচিয়ে।

কথায় বলে ফুলের ঘ্রাণ যাকে মাতাল করে না ফুলের প্রতি তার ভালোবাসাও নাকি অতটা তীব্র হয় না। আসলে প্রকৃতির প্রতি সচেতনতার বিষয়েও ঠিক এই কথাটিই প্রযোজ্য। যে প্রজন্ম কখনো খালি পায়ে হাঁটেনি সবুজ ঘাসের মাটিতে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার চাইতে টয়োটা গাড়িই যে তার কাছে প্রিয় হবে সে তো বলাই বাহুল্য। আপনি হয়তো বলবেন, এই শহরে চাইলেও কি সবুজ ঘাস পাওয়া সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তরটা আর দশ বছর পর কি হবে তা বলা মুশকিল। তবে এই শহর জ্যামে এখনো কিন্তু একটু কষ্ট করলেই দেখা মেলে সবুজের। এই সবুজের ঘ্রাণ পেতে একদিন নাহয় সকালের ঘুমটাকে সমর্পণ করুন প্রকৃতির কাছে। হেঁটে আসুন আশপাশের কোনো পার্ক কিংবা সবুজ ঘাসের মাঠ থেকে। দেখবেন সারাদিনের কাজে সকালের বেড-টি’র চাইতে অনেক বড় টনিক হিসেবে কাজ করবে সকালের এই অভ্যাসটাই। অন্যদিকে বাড়ির সামনে কিংবা বরান্দায় যাদের দশ হাত হলেও খালি জায়গা আছে তারা এ জায়গাটাকেই নাহয় কাজে লাগান। নিজ হাতে বুনে দিন প্রিয় কোনো অর্কিড, পাতাবাহার কিংবা বকুল ফুলের গাছ। নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়, ড্রয়িং রুম আর লিভিং রুমের হাজার টাকা দামী কোনো শোপিসের চাইতে এই একটুকরো সবুজই আপনাকে এনে দেবে অনেক বেশি প্রশান্তি।

অবসরে কিংবা ছুটির দিনে পরিবারের সকলকে নিয়ে যাদের ঘুরতে যাবার অভ্যাস আছে তারা কিন্তু এই ঘুরে বেড়ানোর মাঝেও সামিল করে নিতে পারেন প্রকৃতিকে। এমনিতেই সাগর কিংবা পাহাড়ের হাতছানি আমাদের বড় বেশি টানে। তবে এসবকিছুর পাশাপাশি বৃষ্টির ফোটা গায়ে মেখে আর লোডশেডিং এর কোনো রাতে জ্যোৎস্নামাতাল হতে পারাটাও কিন্তু কম কিছু নয়। আর এমনি করে যাদের মনে প্রকৃতির প্রতি একটা ভালোবাসা জন্ম নেবে তারা কিন্তু শত চাইলেও ভুলে থাকতে পারবেন না আশপাশের প্রকৃতি আর পরিবেশকে।

প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা বাড়ানোর কথাতো অনেকই বলা হলো। কিন্তু নগরের নাগরিকদের ক্রমাগত খামখেয়ালিতে যদি এই প্রকৃতি আর পরিবেশই বিপন্ন হয়ে পড়ে তাহলে ভালোবাসা দিয়ে আর কি হবে। কাজেই প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়াটা যেমন জরুরী তেমনি জরুরী এই প্রকৃতি আর পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখাটাও। আর এজন্য পরিবেশ সচেতন আচরণ রপ্ত করতে হবে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলকেই। ধরা যাক রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কিংবা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই কোনো কিছু খাচ্ছেন আপনি। কিন্তু খাওয়ার পর এই খাদ্যের উচ্ছিষ্ট বা খাবারের মোড়ক যদি ছুড়ে ফেলা হয় রাস্তায় তাহলে তা আমাদের পরিবেশকেই বিপন্ন করবে। আবার যারা ভাবছেন রাস্তায় না ফেলে রাস্তার পাশের ড্রেনে ছুড়ে ফেললেই সব ল্যাঠা চুকে গেলো তারাও কিন্তু নিজের অজান্তেই বারোটা বাজাচ্ছেন পরিবেশের। একথা হয়তো সত্য যে আমাদের দেশে এখনো সব রাস্তার পাশে দেখা মেলে না ডাস্টবিনের। তবু আপনার এই উচ্ছিষ্টগুলো যতটা সম্ভব এমন একটি স্থানে ফেলুন যেখান থেকে হয়তো অনায়াসেই তা সরিয়ে নিতে পারবে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। আবার যারা কারণে অকারণে জল বিয়োগ করে অন্যের বিরক্তির কারণ হন তারাও যত দ্রুত সম্ভব এই বদভ্যাসটি পরিত্যাগ করুন।

ফি বছর সারা বিশ্বে যতটা পরিবেশ দূষণ হয় তার একটা বড় অংশই হয় জ্বালানীর ব্যবহারের কারণে। আর এই জ্বালানীর একটি সিংহভাগ অংশই ব্যয়িত হয় যানবাহন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে। কাজেই আমরা প্রত্যেকেই যদি প্রতিদিন যানবাহনে চড়ার পাশাপাশি কিছুটা হলেও হাঁটার অভ্যাস করি তাহলে তা একদিকে যেমন জ্বালানীর ব্যবহার কমাবে তেমনি সুস্থতা নিশ্চিত করবে ব্যক্তি এবং পরিবেশেরও। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে যেখানে বিদ্যুতের সংকট আমাদের দেশের মতো প্রকট নয় সেখানেও কিন্তু স্রেফ পরিবেশের কথা ভেবে লোকে বছরে একটি ঘন্টা সমস্ত বাতি নিভিয়ে পালন করছে ‘আর্থ ডে’। কাজেই বিদ্যুত সংকটের এই দেশে আপনি আমি অপ্রয়োজনে বিদ্যুৎ না পুড়িয়ে যদি পরিবেশের খানিকটা উপকার করতে পারি তাহলে মন্দ কি।

আসলে পরিবেশকে ভালোবাসবার আর প্রকৃতির কাছে ফিরে যাবার এমনি অনেক কৌশলই হয়তো আপনার আমার জানা। কিন্তু আমাদের খেয়ালী আচরণে যে বিপন্ন পরিবেশ বছর বছর উপহার দিচ্ছে ‘সিডর’ আর ‘আইলা’র মতো প্রাণঘাতি সাইক্লোন সেই পরিবেশকে বাঁচাতে আমরা কি এগিয়ে এসেছি একবিন্দুও। কাজেই ‘এ বছর গরম কেন বেশি পড়েছে’ গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সেই তত্ত্বকথায় না গিয়ে পরিবেশটাকেই নাহয় ভালোবাসুন নতুন করে। নিশ্চিত থাকুন, প্রকৃতি আপনার এই ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবে শত সহস্রগুনে।

1 comments:

Anonymous said...

:)

Post a Comment