RSS

Friday, June 12, 2009

ইটিং ডিজঅর্ডার


পেটে রাজ্যের ক্ষুধা। অথচ টেবিলে সাজানো হরেক পদের খাবার দেখলেই কোথা থেকে যেন রাজ্যের অনীহা এসে উপস্থিত হয় আপনার মনে। টেবিলে বসে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু খাবার পেটে চালান করে দেয়াটাকেও মনে হয় ‘মিশন ইম্পসিবল’ এর মতো এক চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে ‘বলিউডি মুভি’ কিংবা আকাশ সংস্কৃতির জোয়ারে ভেসে যারা স্বপ্ন দেখেন ‘সিক্স প্যাক’ বা ‘সাইজ জিরো’র তাদের কাছে তো খাবার মানেই এক মূর্তিমান বিভিষীকা। পাছে খানিকটা বেশি ফ্যাট আর বেশি কার্বোহাইড্রেট খেয়ে বেমালুম মুটিয়ে যান এই ভয়ে এই দলের খাবার চিন্তাটাই শিকেয় ওঠে। আর এসবকিছুর যোগফল হিসেবে শরীর থেকে বিয়োগ হয় কেবল পুষ্টিটাই। ডাক্তারদের পুঁথিগত সংজ্ঞায়নে খাবারের প্রতি এই অনীহাটাকেই কেতাবী ঢঙে বলা হয় ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’। যদিও অনলাইন বিশ্বকোষ উইকি’র তথ্যানুযায়ী, যারা খাবার দেখে লোভ সংবরণ করতে না পেরে মুহূর্তেই বিশাল পরিমাণের খাদ্য গলাধকরণ করে অস্বস্তিতে ভোগেন তারাও এক অর্থে এই ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ এর শিকার। খাদ্যে অরুচির এই সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন রাশেদুল হাসান শুভ

মন বসে না খাবার টেবিলে

শরীরটা দিব্যি আছে। মুটিয়ে যাবার বাতিকটাও এখনো ঘাড়ে চেপে বসে নি। অথচ খাবার টেবিলে বসলেই কেমন যেন মন উদাস করা একটা অলসতা পেয়ে বসে আপনাকে। কিংবা সারা বেলা আয়েশ করে খাবার টেবিলে বসেই হয়তো সাত তাড়াতাড়ি পাট চুকানোর মতো একটা হুড়োহুড়ি বেধে যায় আপনার মধ্যে। এ কারণে ঠিক যতটা খেলে শরীর ভাল থাকার কথা আপনার শরীরে হররোজ প্রবেশ করে তার চাইতেও বেশ খানিকটা কম খাবার। ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ এ যাদের অবস্থান এই দলে তাদের প্রথমেই মন বসাতে হবে খাবার টেবিলে। আর দশটা কাজের মতো ‘ধর-মার-কাট’ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে খাবার উপকরণের সাথে তৈরি করতে হবে ভালোবাসার একটা সম্পর্ক। এক্ষেত্রে যদি বাসার ফুড মেন্যু আপনার একেবারেই না-পছন্দ হয় তাহলে প্রথমেই পরিবর্তন আনতে হবে এই জায়গাটাতেই। প্রথম অবস্থায় পুষ্টির দিকে না তাকিয়ে শুধুমাত্র ভাললাগার খাবারগুলো বেশি বেশি খেয়ে খাদ্যের প্রতি আপনার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলুন। সেই সাথে প্রতিদিনকার খাবার সময়ও একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসুন। কিছুদিন চলার পর যখন এই অভ্যাসটা রপ্ত হয়ে যাবে তখন আস্তে আস্তে খাবার তালিকায় যোগ করুন পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাবার। এছাড়া খাবার সময় টিভি দেখা বা অহেতুক গল্প করে করে খাবারের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়ার মতো বদভ্যাসগুলোও দূর করুন। অন্যদিকে যাদের ধূমপানের বদভ্যাস আছে তারা খাবার একঘন্টা আগ থেকে শুরু করে খাবার আধঘন্টা পর অবদি ভুলেও ধুম্রশলাকার কাছে ভিড়বেন না। এমনকি কোনো মানসিক বা শারিরীক অস্বস্তির কারণে খাবার গ্রহণে অনীহা দেখা দিলে সেটিও চিকিৎসক বা মনোচিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়ে দ্রুত সমাধান করতে হবে।

খাবারের প্রতি অনাগ্রহ কাজ করার পেছনে অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিও বড় ভূমিকা রাখে। কাজেই আপনার ঘরে যদি বাড়ন্ত শিশু থাকে তবে তাকে অবশ্যই ছোটবেলা থেকে আগ্রহ নিয়ে খাবার গ্রহণের প্রশিক্ষণ দিন। বাচ্চা একেবারেই খেতে চায় না এই অজুহাতে বাচ্চাকে দিনের পর দিন মুখে তুলে না খাইয়ে মাঝে মাঝে ওকে ওর মতো করে খেতে দিন। বড়দের সাথে সাথে ওকেও বসান খাবার টেবিলে। শিশুর জন্য আলাদা প্লেট, গ্লাসের বন্দোবস্ত করে তাকেও খাবারের প্রতি আগ্রহী করে তুলুন।

বেশি খেলে বাড়ে মেদ

‘অনাহারে নাই খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ’ - ‘হীরক রাজার দেশে’র এই ছন্দটিকে যারা তাদের জীবনের আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছেন ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ তাদের সঙ্গী হবারই কথা। কেতাবী পরিভাষায় মুটিয়ে যাবার ভয়ে কম খাবার এই প্রবণতাকেই বলা হয় ‘অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা’। যখন একজন মানুষ অপরিকল্পিত ডায়েটিং এর মাধ্যমে তার ওজন মাত্রাতিরিক্ত কমিয়ে ফেলেন, মোটা হবার ভয়ে খাবার দেখলেই ভীত অনুভব করেন বা কম খাবার কারণে মাথাব্যথা, পেশীর দূর্বলতা, অবসাদ ইত্যাদি রোগে ভোগেন তখন তাকে এই শ্রেণীর বলে ধরে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে সংকট নিরসনে প্রথমেই স্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে হবে ডায়েটিং এবং হেলদি ডায়েট বিষয়ে। শুধু কম খাওয়াটাই যে মুটিয়ে যা প্রতিরোধের মোক্ষম দাওয়াই নয় এটা আত্মস্থ করতে হবে। উচ্চতার বিপরীতে কতটা ওজন আপনার জন্য মানানসই সেটি ঠিকমতো জেনে তারপর ডায়েট নির্ধারণ করতে হবে। তাছাড়া যদি শরীরে কারণে-অকারণে মেদ জমার প্রবণতা দেখা যায় তাহলে অনর্থক কম খেয়ে নিজেকে দূর্বল না বানিয়ে চেষ্টা করতে হবে পরিশ্রমের মাধ্যমে কিছুটা হলেও ক্যালরী পুরিয়ে নিজেকে ফিট রাখার। তাছাড়া অবৈজ্ঞানিক উপায়ে শুধু চোখের দেখায় সিৗম হবার চেষ্টা না করে ফিট বডি বলতে যা বোঝায় সেটিই অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। খাবার, পরিশ্রম এবং ঘুমের একটি পরিকল্পিত রুটিন অনুসরণের মাধ্যমে খেতে বসে প্রতিনিয়ত মুটিয়ে যাবার ভয়টাকেও দূরে ঠেলতে হবে। আবার যারা কারণে অকারণে ওজন মেশিনে দাঁড়িয়ে আজ কতটা ওজন কমলো এই জাতীয় ম্যানিয়াতে ভোগেন তাদেরকেও অবসেশন দূর করে স্বাভাবিক মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। সেই সাথে খাদ্যাভ্যাসের উপর অহেতুক নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরিবর্তে আজেবাজে খাবার কমিয়ে দিয়ে তিনবেলা পেটপুরে আহার করে প্রয়োজনে বাড়তি পরিশ্রম করতে হবে।

বেশি খাওয়ার বিপত্তি

এই দুনিয়ায় একদল যেমন মুটিয়ে যাওয়ার ভয়ে কম খান তেমনি রাতারাতি শুকনো থেকে মোটা হবার আশায় জোর করে বেশি খাবার লোকও আছে। নিজের সাধ্যের অতিরিক্ত খেতে গিয়ে ভজঘট পাকিয়ে ফেলা এই দলটিই হলো ‘বুলিমিয়া’ নামের বিশেষ ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ এর শিকার। এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞরা প্রথমেই জোর দেন সুস্থ থাকার প্রতি। যেখানে সুস্থ আর নিরোগ থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা সেখানে খানিকটা হালকা-পাতলা শরীর নিয়ে দুশ্চিন্তা না করাটাই উত্তম। তবে শরীরের ওজন যদি মাত্রাতিরিক্ত কম হয় তাহলে অহেতুক বাড়তি ডায়েটের দিকে না ঝুঁকে নিউট্রিশিয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী শরীরের চাহিদানুযায়ী ডায়েট চার্টে পরিবর্তন আনতে হবে। অন্যদিকে যারা সারা সপ্তাহজুড়ে ডায়েট চার্ট মেনে চললেও হুট করে কোনো বিয়ে বাড়িতে বা ফাস্টফুডের দোকানে যেয়ে অতিরিক্ত খেয়ে হাসফাস করেন তারাও কিন্তু অন্য ঘরানার ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ এ ভোগেন। ‘বিনজ্ ইটিং ডিজঅর্ডার’ নামের এই ডিজঅর্ডার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হলে শুধুমাত্র মানসিকতার পরিবর্তনটাই যথেষ্ট। চোখের ক্ষুধার পরিবর্তে পেটের ক্ষুধার প্রতি মনোযোগী হওয়া, বুফেতে গিয়ে একসাথে সব আইটেম খাবার মানসিকতা পোষণ না করা কিংবা ফ্রি পেলে যত পারো তত খাও টাইপের আচরণ সংবরণের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারাটাই যথেষ্ট। এছাড়া নির্দিষ্ট কিছু খাবারের প্রতি অনীহা বা অতিমাত্রায় স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে স্বাদের দিকে খেয়াল না রেখে শুধুমাত্র নির্ধারিত কিছু খাদ্য গ্রহণের মতো ব্যতিক্রমী ইটিং ডিজঅর্ডার এ যারা ভোগেন তাদেরকেও নিউট্রিশিয়ান বা ভাল কোনো কাউন্সিলরের সহায়তা নিয়ে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হতে হবে।

0 comments:

Post a Comment