RSS

Thursday, October 29, 2009

স্টাইলে আধুনিক ও সনাতন শাড়ি

নারীর জীবনের যে বর্ণাঢ্য বিবর্তন, তার বেড়ে ওঠা, পরিণত বয়সে পুরুষের সঙ্গে এক নতুন জীবনের সূচনা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে শাড়ি জড়িয়ে আছে নারীকে উৎসবে কিংবা পার্বণে আনন্দ কিংবা বেদনার এক অনুভব বার্তায়। নারী জীবনের নানা অব্যর্থ সূচনায় শাড়ি হয়ে ওঠে তার পরিপূর্ণ রূপ বিকাশের সহায়ক। একটি শাড়ি শুধু ৬ গজ কাপড়ের বুনট নয় বরং তা নারীকে দেয় তার আব্রু রক্ষার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। শাড়ির সুদীর্ঘকালের ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বহন করে। আজ তাই শাড়ি বাঙালি নারীর জন্য এক অভিন্ন অভিরুচির প্রকাশই শুধু নয় বরং বাঙালি নারীর জন্য তা পাসপোর্টস্বরূপ। যখন থেকেই শাড়ির জন্ম ইতিহাস শুরু ঠিক তখন থেকেই বাঙালি নারীর জীবনে শাড়ি মানেই নিজের অঙ্গ সৌষ্ঠবকে আড়ালে আবডালে মোহনীয় করে তোলার এক অপার মাধ্যম। চর্যাপদের পদাবলী কিংবা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-সাহিত্যের সব আদি উপাদানেই বাঙালি নারীর জীবনে শাড়ির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। তাই নিয়ে লিখেছেন মোর্শেদ নাসের টিটু

নানা ধরনের শাড়ি

নারীর জীবনের নানা ধরনকে কেন্দ্র করে বদলে যায় শাড়ির চরিত্র। ঘরে পরবার জন্য যে শাড়ি ব্যবহৃত হয় জন্মদিনের পার্টিতে বা বিয়ের উৎসবে শাড়ির ধরন সেই একই রকম থাকে না। আবার পহেলা ফাল্গুনে বাঙালি নারী তার ঐতিহ্যকে ধারণ করতে বদলে ফেলে শাড়ির ধরন। পহেলা বৈশাখে উৎসবের আনন্দে শাড়ির রং ও ধরন বদলে যায় আবার। এছাড়াও ঈদ উৎসবে কিংবা দোল পূর্ণিমায় কিংবা দুর্গা পূজায় শাড়ির ধরন হয়ে যায় আরেক রকম। উৎসবের নানা ক্ষেত্র বিশেষে নারী নিজেকে আমূল বদলে ফেলে শাড়ির এক ভিন্ন ভঙ্গিমায়। উৎসব নির্ভর এ বদলে যাওয়ার ঢঙে শাড়ির নামের বহরও বদলে যায়। কখনও কখনও তাতে কাপড়ের ধরন নির্ভর করে, সূতার উপাদান দেখতে হয়। নানা নামের সেই শাড়িগুলো নারীর কাছে অচেনা নয়। যেমন ফ্রেঞ্চ শিফন, সিল্ক শিফন, প্রিন্টেড শিফন, জর্জেট, ক্রপ জর্জেট, নাইলন জর্জেট, ঢাকাই জামদানী, সিল্ক, টাঙ্গাইল সিল্ক, রাজশাহী সিল্ক, সিল্ক শার্টিন, মাইসোর সিল্ক, সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্ক, বমসাই সিল্ক, কাশ্মীর সিল্ক, কাতান, কাঞ্জিভরম, ব্যাঙ্গালোর শাড়ি, বেনারসি, টিস্যু বেনারসি, তাঁতের শাড়ি, টাঙ্গাইল শাড়ি, সপুরা সিল্ক, চোষা শাড়ি, ব্লক প্রিন্টেড শাড়ি, এমব্রয়ডারী শাড়ি, কোটকী শাড়ি, ক্যাম্পল শাড়ি, মনিপুরি শাড়ি, লেসের শাড়ি, অর্গাঞ্জা, কোটা শাড়ি, গরদের শাড়ি, তসরের শাড়ি, কাঁথা শাড়ি, ছাপা শাড়ি, টাইডাই শাড়ি, হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ি, ধনেখালি ইত্যাদি নানা রং ও রূপে, উৎসবের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন প্রয়োজনে শাড়ি নারীর রূপ সৌন্দর্য বিকাশে সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের এবারের আলোচনায় এই সময়ের প্রধান তিন ধরনের শাড়ি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

বুটিকের শাড়ি

তাঁতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আশির দশকের শেষভাগ থেকে আমাদের দেশে এক ভিন্নধারার শাড়ির রেওয়াজ চালু হয়েছে যা বুটিকের শাড়ি হিসেবে খ্যাত। বিভিন্ন বুটিক হাউজ নতুন কিছু মাধ্যম ব্যবহার করে শাড়ির এ স্পেশাল ধারাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। বুটিকের শাড়ির ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে ব্লক প্রিন্ট শাড়ি। এছাড়াও টাইডাই শাড়ি, বাটিক শাড়ি, এমব্রয়ডারী শাড়ি, হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ি ইত্যাদির নানা ধারাও বুটিককে কেন্দ্র করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এ বুটিকগুলোতে একঝাক তরুণরা কাজ করছে এবং প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় চেষ্টা করছেন এক নতুন, সুন্দর এবং আকর্ষণীয়ভাবে শাড়িকে উপস্থাপন করতে যাতে নারী তার রুচিশীল পছন্দের শাড়িটি বেছে নিতে পারে খুব সহজেই।

ছাপা শাড়ি

সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে বাংলাদেশে ছাপা শাড়ির জনপ্রিয়তার শুরু। তখন ছাপা শাড়ি হিসেবে বাজারে ভারতীয় শাড়ি ছিলো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। সেই সময়ই হালকা ওজন, রঙিন জৌলুস আর বড় ছাপার নকশার মধ্যদিয়ে ছাপা শাড়ির জগতে জনী শাড়ির আবির্ভাব। তখন পাবনায় তৈরি শাড়ি ওজনে ভারী আর ধোয়ার পর খেপে যেতো বলে নারীরা তা পছন্দ করতেন না খুব বেশি। তাই তখন পাবনার বিটি শাড়ির চাহিদা কমে আসছিলো। এ সময়ই জনী নিয়ে এলো সম্পূর্ণ দেশীয় নামে ১২ হাতের ছাপা শাড়ি। আড়াই হাজারে বোনা হচ্ছিল কাপড় আর ছাপা হচ্ছিলো নিজেদের কারখানাতেই। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে ছাপা শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। টাঙ্গাইল বা পাবনার শাড়ির পাশাপাশি মফস্বল এলাকাগুলোতে ছাপা শাড়ির জনপ্রিয়তা খুব বেশি। ছাপা শাড়ির দামও ক্রেতার নাগালের মধ্যেই। ১২ হাতের ছাপা শাড়ি আমাদের দেশের যে চিরন্তন ঐতিহ্য তা ফুটিয়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশী ফোক মোটিভ লতাপাতা, রঙ বিন্যাস ও কোয়ালিটির ক্ষেত্রে ছাপা শাড়ি এক বিশাল ভান্ডার তৈরি করে চলেছে।

ডিজাইনার্স শাড়ি

আমাদের দেশে এখনও সেরকম প্রবলভাবে নিজের জন্য শাড়ি ডিজাইন করা হবে একেবারে আলাদাভাবে এরকম চিন্তা-ভাবনা খুব বেশি গড়ে ওঠেনি। তাই ডিজাইনার্স শাড়ির কদরও খুব বেশি নেই। অথচ পাশের দেশ ভারতে ডিজাইনার্স শাড়ির কদর অনেক বেশি। ডিজাইনার্স শাড়ি বলতে সাধারণত ধারণা করা হয় নিজের পছন্দমাফিক কোনো ডিজাইন বা মোটিভ একজন ডিজাইনার দ্বারা শাড়িতে ফুটিয়ে তোলাকে। আমাদের দেশের ইদানীংকার কোনো কোনো ডিজাইনার স্পেশাল অকেশনে এই কাজটি করে থাকেন। এক্ষেত্রে চার্জটা পড়ে খানিকটা বেশি। তবে নারীর সৌন্দর্য বিকাশে তা হয়ে ওঠে এক ও অদ্বিতীয়।

নারীর সুখ দুঃখের ব্যাপ্তিতে আর পোশাকের বিবর্তনে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম আর নতুন ঢঙের পোশাক। বাজার সংস্কৃতির যুগে স্যাটেলাইট চ্যানেলের দাপটে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে আমাদের পোশাকের সংস্কৃতি। পশ্চিম মনস্ক আমাদের মন আধুনিক হওয়ার চেষ্টায় প্রতিনিয়ত গ্রহণ করছে নতুন নতুন পোশাকের কাটিং আর বৈচিত্র্যময় ডিজাইন। মজার বিষয় এতসব আধুনিক স্পর্শের ভিড়ে এখনও বদলে যায়নি আমাদের চিরায়ত সৌন্দর্যের প্রতীক, নারীর আব্রু রক্ষার আদি উপাদান এবং আমাদের সংস্কৃতির এক দীর্ঘ ঐতিহ্য। তাই বাঙালি রমণী আজও আয়নায় তার প্রতিবিম্বে অঙ্গ সৌষ্ঠবে খুঁজে ফেরে শাড়ির স্পর্শ। নামে, ডিজাইনে কিংবা রং ভিন্নতায় যাই হোক না কেন নারীর কাছে বদলে যাওয়া জীবন ধারায় এক অতুলনীয় নির্ভরযোগ্য পোশাক সংস্কৃতিঃ তবুও শাড়ি।

0 comments:

Post a Comment