জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয় বিয়ের মধ্য দিয়ে। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা স্মরণীয় করে রাখতে মানুষের চেষ্টার অন্ত নেই। বিয়ের অনুষ্ঠানের সবকিছুই হওয়া চাই একদম মনের মতো। তাই সময় হাতে রেখেই বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
বিয়ের কেনাকাটার জন্য বিদেশ যেতে হবে, এমন ভাবনার দিন শেষ। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য পোশাক থেকে শুরু করে গয়না, জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি অনুষঙ্গ এখন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। চমত্কার ডিজাইন, উন্নত মান আর সাশ্রয়ী দামে এসব কিছুই এখন আমাদের দেশের ডিজাইনাররা তৈরি করছেন। দেশের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির ছোঁয়াও তাই এর মধ্যে ষোল আনাই থাকে।
বিয়েতে কনের পোশাক অনেক বড় একটি বিষয়। তাই প্রথমেই এ বিষয়ে পরিকল্পনা করে ফেলা যাক। দেখবেন এটা হয়ে গেলে অনেক কাজই সহজ হয়ে গেছে। কনে যেহেতু বিয়ের আয়োজনের মধ্যমণি তাই তার পোশাকটিও হওয়া চাই সে রকমই। এ সময় কনের পোশাকে এসেছে ভিন্নতা। যাঁরা মনে করতেন দেশীয় পোশাকে বিয়ের জাঁকজমক ভাবটা নেই, তাঁরা এবার একটু অন্যভাবে চিন্তা করে দেখতে পারেন। কারণ দেশীয় ডিজাইনাররা দেশীয় উপাদানেই তৈরি করছেন জমকালো সব পোশাক। তাই কনেকে বিয়ের আয়োজনে পানচিনি থেকে বৌভাত পর্যন্ত আর পরতে হবে না বিদেশি কোনো শাড়ি।
ফ্যাশন হাউস ড্রেসিডেলের কার্যনির্বাহী পরিচালক মায়া রহমান বলেন, ‘এখন মসলিন, জামদানি, জর্জেট, কাতান, নেটের শাড়িতে দেশেই তৈরি হচ্ছে চমত্কার সব ডিজাইনের শাড়ি। তাই কনের জন্য শাড়ি কিনতে গিয়ে এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে, যেন পানচিনি, গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌভাত—এই চার অনুষ্ঠানে চার ধরনের শাড়ি পরতে পারে। প্রতিদিনই একই রকমের শাড়ি পরলে তাতে একঘেয়েমি এসে যেতে পারে।’
ফ্যাশন ডিজাইনার মাহিন খান মনে করেন, বাংলাদেশের জামদানিতে যে আভিজাত্য আছে, অন্য কোনো শাড়িতে সেই আভিজাত্য প্রকাশ পায় না। জামদানি বা মসলিনের পোশাক মোগল আমল থেকেই ব্যবহূত হয়ে আসছে রাজকীয় আয়োজনে, তাই এ ধরনের শাড়ি বিয়ের জৌলুশ আরও বাড়িয়ে তোলে।
কোন অনুষ্ঠানে কেমন শাড়ি হতে পারে, তা নিশ্চয়ই ভাবছেন সবাই।
পানচিনিতে জর্জেট বা জামদানি পরতে পারেন। জর্জেটে খুব বেশি কাজ আবার ভালো দেখাবে না। মনে রাখতে হবে, এ আয়োজনের মাধ্যমেই বিয়ে উত্সবের শুরু, তাই যতটা সুন্দর ও রুচিসম্মতভাবে সাজা যায় ততই ভালো।
মায়া রহমান মনে করেন, পানচিনির অনুষ্ঠানের জন্য পিচ, গোলাপি, নীল, বেগুনি রঙের শাড়ি বেশি মানানসই। শাড়িতে যেন খুব বেশি কাজ করা না হয়। সেই সঙ্গে মানানসই একটা সাজসজ্জাও থাকা চাই। খুব বেশি জমকালো ভাব এড়িয়ে যেতে হবে। স্নিগ্ধ ও কোমল ভাব ফুটে ওঠা চাই। মাহিন খানের মতে, অ্যান্ডি ও মসলিনের মিশ্রণে কোনো শাড়িও হতে পারে এ ধরনের আয়োজনের জন্য মানানসই।
গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান নাকি হলুদ শাড়ি ছাড়া হবেই না। এ রকম ধারণা এ সময় এসে একটু পরিবর্তন হচ্ছে। এখন কেবল হলুদ নয়, বরং লাল, কাঁচা মেহেদিরঙা বা সবুজ শাড়িও বেশ চলছে। তবে হলুদ শাড়িতে সবচেয়ে বেশি ভালো দেখায় ঐতিহ্যবাহী তাঁতে বোনা শাড়ি। সেটা সিল্ক হোক কিংবা সুতি। শাড়িতে চওড়া জরিপাড় থাকতে পারে। তবে এখন কেউ কেউ মসলিন, জর্জেট শাড়িও পরছেন। মায়া রহমান মনে করেন, বিয়ে বা বৌভাতে না পরতে চাইলেও হলুদে অন্তত হলুদ জামদানি পরতে পারে কনে।
হলুদের শাড়ির সঙ্গে মানিয়ে ফুলের গয়না তৈরির রেওয়াজটাকেও কিন্তু মাথায় রাখতে হবে। নইলে কিন্তু একদমই মাঠে মারা যাবে হলুদের সাজসজ্জা। শুকনো ফুলের সঙ্গে পুঁতি, জরির মিশেলে অনেকে গয়না পরে। অনেকের আবার কাঁচা ফুলটাই পছন্দ। রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান মনে করেন, যেমন গয়নাই পরা হোক না কেন, ফুলের আকার যেন ছোট হয়। নইলে জবরজং দেখাবে। একটু ভিন্নতা আনতে চাইলে রুপার গয়নাও পরা যেতে পারে। হাতে থাকতে পারে কাচের চুড়ি। কনের সুবিধার জন্য অনেকেই এখন হলুদের শাড়ির সঙ্গে ওড়না পরে থাকে।
বিয়ে মানেই বিশাল আয়োজন। আর এ কারণেই বিয়ের পোশাক হতে হবে এমন, যেন কনেকেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়। এখন যে জর্জেট শাড়ির ফ্যাশন, তাতে এবার মনে হয় একটু করে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে আরম্ভ করেছে। জর্জেটে পুরোটা জুড়েই কাজ নয়। বরং বুঝেশুনে এমনভাবে কাজ করা হচ্ছে, যাতে শাড়িটি কনে একবার পরেই বাক্সবন্দী না করে। বরং বহুবার পরার কথা মাথায় রেখেই শাড়িটি তৈরি করা হচ্ছে।
বিয়ের শাড়ি মানেই যেন লাল রং। আর এ লাল রঙের বেনারসিই ছিল একসময়ের বিয়ের শাড়ির চলে। টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের স্বত্বাধিকারী মুনিরা ইমদাদ বললেন, ‘বিয়েতে এখন আবার কাতান বেনারসি পরার চল শুরু হয়েছে। আর এ কারণেই সবাই খোঁজ করছে আঁচল আর পাড়ে পেটানো কাজের কাতান, যার জমিন জুড়ে থাকবে কেবলই বুটি।’
এ ধরনের শাড়ির চল যেমন আবার শুরু হচ্ছে, তেমনিভাবে জামদানিতেও ভালো মানের জরি ব্যবহার করে এর সঙ্গে মিলিয়ে ব্লাউজ পিস, ওড়নাসহ তৈরি হচ্ছে বিয়ের শাড়ি। বিয়ের দিনের জন্য জামদানি বাছতে গিয়ে অনেকেই পছন্দ করছেন লাল রঙের শাড়ি। আবার জামদানি বা বেনারসি না হয়ে যদি মসলিন বা জর্জেট হয়, সে ক্ষেত্রেও প্রাধান্য পাচ্ছে লাল রং। আর এ ধরনের শাড়িতে ড্রেসিডেল তাদের ব্রাইডাল ডিজাইনে রাখছে অ্যাপ্লিক, প্যাচওয়ার্ক, রিবনওয়ার্ক এবং হাত ও মেশিন এমব্রয়ডারি। নেট ও মসলিনে এ ধরনের অ্যাপ্লিক করা হচ্ছে ক্রাশড সিল্কের কাপড় দিয়ে।
শাড়ির সঙ্গে আনুষঙ্গিক
এই সময়ে বিয়ের কনের জন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ক্লাচ ব্যাগ। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে, আবার মাঝেমধ্যে বিপরীত রঙে, নকশা করেও কনেরা নিচ্ছে ক্লাচ ব্যাগ। ড্রেসিডেলে ক্লাচ ব্যাগের দাম ২৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা। মায়াসীরেও ব্রাইডাল ব্যাগ ১২৫০ থেকে ২৫০০ টাকা। আর আড়ংয়ে ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা। এ ছাড়া আড়ংয়ে আছে বটুয়া ব্যাগ একই দামে। এর বাইরেও বিভিন্ন শপিং মলে এবং চাঁদনী চকে পাওয়া যাবে বিয়ের ব্যাগ ৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায়।
স্যান্ডেল শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে কিনতে গেলে সবার পছন্দের দোকান রাখী শ্যু’জ। এখানে হলুদের স্যান্ডেল ৫০০ টাকায় পাওয়া যাবে, যা কোলাপুরি বলে পরিচিত। এ ছাড়া আড়ং, মায়াসীরে স্যান্ডেল পাবেন ৫০০ থেকে ১৪৫০ টাকায়। রাখীতে কনের স্যান্ডেল পাওয়া যাবে ১০০০ থেকে ৩০০০ টাকায়। এ ছাড়া আলমাসে পাওয়া যাবে কনের জন্য জমকালো ব্যাগ ও স্যান্ডেল।
গয়না
গয়নার ক্ষেত্রে ফিরে এসেছে কানের ঝুমকা ও গলার সীতাহারের ডিজাইন। তবে এখন অনেক গয়না পরার চেয়ে কনের শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে একটি গয়না পরার চলই বেশি দেখা যাচ্ছে। সোনার গয়নার ভরি এখন ৩১০০০ টাকা। আড়ংয়ে তৈরি করা পাথর বসানো গয়নার দাম সেটপ্রতি ৬০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। ইদানীং সোনার দাম বেশ বেড়ে যাওয়ায় সোনার প্লেট করানো গয়নার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। মায়াসীরে পাওয়া যাবে এ ধরনের গয়নার সেট। আবার চাঁদনী চকের গয়নার দোকান থেকে ফরমায়েশ দিয়ে বানাতে বা কিনে নিতে পারেন।
0 comments:
Post a Comment