RSS

Saturday, November 7, 2009

অটিস্টিক শিশু : অভিভাবকের করণীয়


একটি পরিবারে যখন একটি শিশুর জন্ম হয়, সেই শিশুটিকে ঘিরে হাজারো কল্পনার জাল বোনেন তার মা বাবা। পাশাপাশি অনেক দায়িত্ব এসে পড়ে পরিবারটির উপর শিশুটিকে সুষ্ঠুভাবে লালন পালন করার ব্যাপারে। সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে থাকা শিশুটির বিকাশের পথে যদি কোন প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়, আর তা যদি হয় ‘অটিজম’ তা হ’লে সেই পরিবারটির যে বিড়ম্বনা আর কষ্ট তা অন্য কারো অনুভব করার শক্তি নেই।

মা, বাবা বুঝে উঠতে পারেন না কি করবেন, কার কাছে যাবেন, কোথায় ভাল চিকিৎসা হবে, কত দ্রুত এর সমাধান হবে ইত্যাদি।

পিতা-মাতার এই মুহূর্তগুলোতে এমন মানুষগুলোর সহযোগিতা দরকার যারা শিশুটির জন্য কি করণীয় তার একটা দিক নির্দেশনা দেবেন, মা বাবাকে এবং গোটা পরিবারকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সহায়তা করবেন এবং দেশের ভেতর কোন কোন স্থানে গিয়ে ‘অটিজম’ বিষয়ে আরো ভাল সার্ভিস পাবেন সেই বিষয়ে সহযোগিতা করবেন।

অদ্যবধি অটিজমের কারণসমূহের সুষ্ঠু প্রমাণ না মিললেও এটা সম্পূর্ণ প্রমাণিত যে অটিজম ব্রেনের বিকাশগত সমস্যা।

গত ১০ বছরে অটিজমের চিকিৎসার বিষয়ে প্রচুর উন্নতি সাধিত হয়েছে। এসেছে অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক উন্নত কৌশলগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ যা অনেক অনেক অটিস্টিক শিশুর জীবনকে করছে অর্থবহ, কর্মময় ও স্বাভাবিক।

একটি শিশুর যখন ডায়গনোসিস হয় ‘অটিজম’, মা বাবার কাছে আমার অনুরোধ- ভেঙ্গে পড়বেন না। মনে রাখবেন একটি গঠনমূলক পরিবার, শিশুটির জন্য সুন্দর পরিবেশ, সর্বোপরি একজন তৎপর, সাহসী মা বাবা একজন অটিস্টিক শিশুর জীবন বদলে দিতে পারে।

অটিজম সম্পর্কে ভুল ধারণা, শত বছরের পুরানো কুসংস্কার- একটি অটিস্টিক শিশুর পরিবারকে শেষ করে দেয়। তাই অভিভাবকদের উচিত অটিজমের আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। সেক্ষেত্রে অটিজম বিষয়ে যারা কাজ করছেন যথা চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, থেরাপিস্ট সকলের পরামর্শ নেয়া খুব জরুরি।

একটি অটিস্টিক শিশুর অনেক উন্নতি সম্ভব। তবে সম্ভব হয়, যদি মা বাবা শিশুটির উন্নতি চান। মনে রাখবেন অটিজমের কোন যাদুকরী চিকিৎসা নেই। সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা হচ্ছে শিশুটির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।

একটি অটিস্টিক শিশুর পরিবার/অভিভাবক যদি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে তার শিশুর জন্য একটি গঠনমূলক, অর্থপূর্ণ পরিকল্পনা নিতে পারেন তাহলেই কিন্তু আমাদের এই শিশুরা দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।

সঠিক বিশেষজ্ঞ সনাক্তকরণ

একটি ফুটফুটে শিশুর (৩ বছরের মধ্যে) যদি যোগাযোগের সমস্যা দেখা যায়, যেমন শিশুটির সময়মত কথা আসছে না, কিংবা একই কথা বার বার বলছে, খেলনা দিয়ে সঠিকভাবে খেলছে না, চোখে চোখে তাকাচ্ছে না এবং সম বয়সীদের সাথে মেশার কোন আগ্রহই নেই এবং আরো অনেক সমস্যা তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া জরুরি।

অটিস্টিক শিশুদের বেলায় সঠিক বিশেষজ্ঞ বেছে নেয়া অভিভাবকদের জন্য একটি দূরূহ কাজ। এ ধরনের শিশুদের জন্য ভাল বিশেষজ্ঞ তারা যারা-

০ অভিভাবকদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।

০ অভিভাবকদের কথা বিশ্বাস করেন।

০ শিশুর আচরণের দিকে বেশি খেয়াল করেন।

০ প্রয়োজনে শিশুর চিকিৎসার জন্য তাকে কার্যকরী ও উপযুক্ত স্থানে প্রেরণ করেন।

০ অটিজম বিষয়টি যুুক্তিযুক্ত ও ইতিবাচকভাবে অভিভাবকদের কাছে বর্ণনা করেন।

০ সর্বোপরি অটিজম বিষয়ে যে বিশেষজ্ঞের ভাল ধারণা আছে।

বাসায় গঠনমূলক প্রোগ্রাম

প্রত্যেকটি অটিস্টিক শিশু কিশোর স্বতন্ত্র। তাই তাদের দক্ষতা ও প্রতিভা যেমন স্বতন্ত্র তেমনই তাদের সীমাবদ্ধতাও স্বতন্ত্র। তাই প্রত্যেকটি মা বাবাকে তার শিশুর দক্ষতা ও সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বুঝতে হবে। আপনার শিশুটির জন্য অর্পিত শিক্ষা কার্যক্রম, কর্ম পরিকল্পনার ও অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি বাড়িতে যদি একটি সুন্দর গঠনমূলক প্রোগ্রাম তৈরি করা যায় তাহলে অবশ্যই আপনার শিশুর অনেক উন্নতি সম্ভব।

০ পরিবারের গঠনমূলক প্রোগ্রামটি হবে পরিবারের নিজস্ব রুটিনের ভেতর যেখানে পরিবারের সকলের অংশগ্রহণ জরুরি।

০ বাড়ির পরিবেশটি শিশুর পছন্দসই করুন।

০ যোগাযোগ, সামাজিকতা, খেলাধূলাসহ যে কাজগুলো শিশুটির জন্যে গ্রহণযোগ্য হবে সেই কাজগুলো নিন।

০ যোগাযোগ বাড়ানোর প্রশিক্ষণে ছবির ব্যবহার অপরিহার্য।

০ ২-৫ বছরের অটিস্টিক শিশুর জন্য প্রত্যেকটি কাজ খেলার ছলে করুন।

০ কাজের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিশুটির কাজের তালিকা তৈরি করুন যেমন- টয়লেট ট্রেনিং, যোগাযোগ, ব্যবহারিক সমস্যা ইত্যাদি এবং কাজ সারিবদ্ধ করুন সহজ থেকে কঠিন।

০ যে কয়টি কাজ করতে পারবেন সেগুলো শুরু করুন এবং কাজের সময় আনন্দময় পরিবেশ বজায় রাখুন।

০ সেই কাজগুলো বেছে নিন যেগুলো বাসার পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, পরিবারের সবাই যেই কাজে সহযোগিতা করতে পারবে।

০ শিশুর প্রত্যেকটি অর্জিত দক্ষতাকে প্রশংসা করুন, শিশুটির সাথে তার বয়সী আচরণ করুন। সুন্দর একটি কাজ করার জন্য শিশুটিকে পুরস্কৃত করুন।

০ তিরস্কার কিংবা মারধর করা একদম পরিহার করুন।

০ শিশুটির যদি স্কুলে পড়ে, তবে দৈনিক শ্রেণী শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ রাখুন এবং স্কুল ও বাসা একইভাবে কাজ করুন।

০ শিশুটিকে পছন্দ করার সুযোগ দিন এবং পছন্দের খেলনা দিয়ে সঠিকভাবে খেলা শেখান।

০ শিশুটির ভাইবোনকে কাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন এবং তাদেরও সময় দিন।

০ শিশুটির সামাজিকতা বৃদ্ধির জন্য আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যান, তাদেরও বেড়াতে আসতে উৎসাহিত করুন।

০ অটিস্টিক শিশুর সাথে কাজগুলোর দুইভাবে ভাগ করা যায় যেমন ১:১ পদ্ধতিতে কাজ এবং দলগতভাবে কাজ। এই দুই পদ্ধতির কাজ শিশুর যোগাযোগ ও দক্ষতা বিকাশের জন্য জরুরি। এই কাজের প্রশিক্ষণে আপনি প্রয়োজনে বিশেষ প্রশিক্ষকের পরামর্শ নিন।

০ প্রত্যেকটি কাজের ক্ষেত্রে শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করুন।

০ শিশুটিকে খেলা, কাজে, বিশেষ করে বাসার নিত্য নৈমিত্তিক কাজে যেমন ব্যস্ত রাখবেন তেমনই পাশাপাশি অবসর কাটানোর প্রক্রিয়াও শেখাবেন।

০ শিশুর প্রত্যেকটি কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অভিভাবকের স্পষ্ট ধারণা থাকা বাঞ্চনীয়।

০ শিশুর ছোট ছোট অর্জনকে উপভোগ করবেন উৎসাহ দিয়ে, শিশুটিকে পুরস্কৃত করে, আদর করে।

উপযুক্ত স্কুল

একটি অটিস্টিক শিশুকে দ্রুত সনাক্ত করে তাকে সঠিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পৃক্ত করা যেমন জরুরি তেমনই জরুরি ৩-৫ বছরের ভেতর শিশুটিকে স্কুলে দেয়া। শিশুটির যোগাযোগের ধরণ, অটিজমের তীব্রতা, ব্যবহারিক সমস্যা, আরো অন্যান্য সমস্যার উপর নির্ভর করে তা হতে পারে বিশেষ স্কুল (বিশেষ করে অটিস্টিক বাচ্চাদের স্কুল) অথবা সাধারণ স্কুল।

এখানে সকলের জানা দরকার যে, মৃদু অটিস্টিক শিশু কিশোর কিংবা মেধাবী অটিস্টিক শিশু কিশোররা অনায়াসে সাধারণ স্কুলে লেখাপড়া করতে পারে। শুধু দরকার একটু সহযোগিতা, অটিজম সম্পর্কে মানবিক সচেতনা।

শিশুর উন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্কে খুবই নিবিড় হওয়া প্রয়োজন। মনে রাখবেন সব শিক্ষা পদ্ধতি/ প্রশিক্ষণ সকল অটিস্টিক শিশুর জন্য একইভাবে প্রযোজ্য নয় আবার একটি শিক্ষা পদ্ধতি একটি শিশুর জন্য যথেষ্ঠ নয়।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা

আস্তে আস্তে বড় হবে আপনার শিশুটি। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে আরো আগে থেকেই। এই শিশুদের ১০ বছরের পর থেকেই পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি নিতে হবে।

যেই বিষয়ে আপনার শিশুর দক্ষতা ভাল সেই বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে শিশুটিকে ভবিষ্যতের একজন আত্মনির্ভরশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এখন থেকেই নিতে হবে।

অভিভাবক সহায়তা গ্রুপ

অটিস্টিক শিশুকে নিয়ে একটি পরিবারের সুখ, দুঃখ বেদনার কথা আর একজন অটিস্টিক শিশুর অভিভাবকই ভাল অনুভব করতে পারবেন। তাই একজন অভিভাবক আর একজন অটিস্টিক শিশুর অভিভাবকের কাছে তার সুখ, দুঃখের কথা, তার অভিজ্ঞতার কথা অনায়াসে ব্যক্ত করতে পারেন। অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে এক অভিভাবক অন্য অভিভাবকের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে।

তথ্য ও প্রযুক্তি

বিগত ১০ বছরে অটিজম বিষয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি আমাদের জানার সুযোগকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। তাই অভিভাকদের কাছে অনুরোধ অটিজম বিষয়ে নতুন তথ্যবহুল বই, ইন্টারনেটে তথ্যাদি জানতে চেষ্টা করুন। সেমিনার, কর্মশালায় অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করুন। যে কোন স্থান থেকে বালিকণার মত এতটুকু তথ্য/জ্ঞান যদি আপনার শিশুর কাজে লাগাতে পারেন সেটাও হবে অনেক পাওয়া। পরিশেষে অভিভাকগণ মনে রাখবেন আপনার শিশুটিকে আর কোন শিশুর সাথে তুলনা করবেন না। প্রত্যেকটি শিশুর মত অটিস্টিক শিশুরাও প্রত্যেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভরপুর।

ডাঃ রওনার হাফিজ
চেয়ারপারসন, অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন

0 comments:

Post a Comment