RSS

Monday, January 10, 2011

পরিবারকে সময় দিন

নিজের আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় সন্তানের সংস্পর্শে। আর শুধু সন্তান নয়; বরং মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়েই দুজন মানুষের যে অবকাঠামো, তাকেই আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পরিবার হিসেবেই জানি। মূলত এই পরিবারেই লুকিয়ে আছে আমাদের প্রতিদিনের আনন্দ আয়োজন। তাই প্রতিদিনের জীবনধারায় কর্মমুখর চিন্তার বাইরে পরিবারকেও দিতে হবে আলাদা করে সময়। পারিবারিক অবকাঠামো এবং তার ভেতরে এই আনন্দ খুঁজে নেয়ার চেষ্টাকেই কেন্দ্র করে আমাদের এবারের আয়োজন।

পরিবার হলো পৃথিবীর মূল ইউনিট। পারিবারিক আবহের কথা চিন্তা করলে পুরো পৃথিবীটাই একটা পরিবার। সমাজ বিজ্ঞানীদের ভাষায়, সমাজের শুরুটাও পরিবারের স্পর্শে। যদিও এক সময় পরিবার বলে কিছু ছিল না। আদিম কালের সেই পরিস্থিতির ক্রমন্নোয়ন ঘটেছে সভ্যতার বিকাশে। সভ্যতার হাত ধরেই পৃথিবীতে 'গ্রুপভিত্তিক পরিবার'-এর সূত্রপাত হয়, অনেকটা গোত্রপ্রথার মতো। এই পারিবারিক অবকাঠামোতে পারস্পরিক সহিষ্ণুতার অভাব আর সন্তানের পরিচয়ের সংকট দেখা দিলে, 'গ্রুপভিত্তিক পরিবার'-এ ভাঙনের সূচনা ঘটে। তারই ধারাবাহিকতায় তৈরি 'জোড়াপরিবার'। সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে এটি ছিল একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থা।

সমাজের নানা ব্যবস্থার বিকাশের ভাঙন আর গঠনের হাত ধরে মানুষ এক সময় চিরস্থায়ী রূপ হিসেবে 'একক পরিবার' ব্যবস্থাকে বেছে নেয়। পরিবারের এই ধারণাটি বিকশিত হয় একটি সরল সমাজনীতির ভিত্তিতে। নর-নারীর সম্পর্কে পারস্পরিক বোঝাপড়া আর শেয়ারিং 'একক পরিবার' ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এই কঠিন পৃথিবীর বুকে তখন থেকেই পরিবারই হচ্ছে আপন অস্তিত্ব বিকাশের এক টুকরো মরূদ্যান। সমাজে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, ব্যক্তির সমম্বয়েই সমাজ। ব্যক্তির যাবতীয় বিকাশ, মননগত উন্মেষ এবং ব্যক্তিত্ব গঠিত হয় পারিবারিক অবকাঠামোর ভেতরেই। মূলত একজন পরিপূর্ণ মানুষের সর্বোচ্চ বিকাশ একটি সুন্দর ও সুষম পরিবারেই সম্ভব। তাই পরিবার ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিদ্যমান পারিবারিক সম্পর্ক। আমাদের চারপাশে বর্তমানের যে চলমান সংকট, তার পেছনেও পারিবারিক অবকাঠামোর অবদান কম নয়।

আসলে পরিবারই একজন মানুষকে ধাপে ধাপে তৈরি করে। একটা মানুষ সেভাবেই বেড়ে উঠবে, পরিবার তাকে যেভাবে গড়ে তুলবে। প্রকৃতপক্ষে শিশুর সঠিক মানসিক বিকাশের জন্য পরিবারের সানি্নধ্য খুবই প্রয়োজনীয়। স্নেহ, মায়া, যত্ন এবং প্রয়োজনে শাসনতো প্রথমে পরিবার থেকেই আসবে। মা-বাবা, ভাই-বোনের আদর-সোহাগ বড় বেশি প্রয়োজন তার। ফলে সে নিজেও পরিবারকে নিজের বলেই ভাববে। যেকোনো আনন্দ ও দুঃখ পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করবে। বলা হয়, এখন বিজ্ঞানের যুগ, উন্নত প্রযুক্তির যুগ, ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগ। কিন্তু হাসি, আনন্দ, যত্ন, সমবেদনা, ভালোবাসা, মানুষে মানুষে সহমর্মিতা গড়ে ওঠে যে পরিবার থেকে, ব্যক্তি তার বাইরে কিছু নয়। পরিবার মানেই ব্যক্তির বন্ধনের সূচনা। তাই ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বড় সম্বল পরিবার। ব্যক্তি তখনই শক্তিশালী হবে, যখন পারিবারিক অবকাঠামো হবে শক্তিশালী ও মজবুত। তাই রাষ্ট্র ও সমাজসহ সবার দায়িত্ব পরিবারকে শক্তিশালী করা। মানুষের শক্তি ও আস্থার যে নিশ্চিত স্থান, দিনশেষে বিশ্রামে ফিরে যাবার আপন জায়গা পরিবারগুলো দিন দিন কেবল বদলে যাচ্ছে। 'ফ্রিডম', 'ফ্রিনেস' আর 'ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের' দোহাই দিয়েই ঘটছে এসব। পরিবারগুলোর এই হঠাৎ বদলে যাওয়া বড় রকমের সংকট ডেকে আনছে। সবাই এখন পরিবারের গন্ডিকে ছোট করে নিয়ে আসতে চায়, একা থাকতে চায়। নিজের সুখ, নিজের আনন্দই প্রাধান্য পাচ্ছে সবার চিন্তায়। প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ। তথাকথিত আধুনিকতা প্রসারিত হচ্ছে বলে আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য বদলে যাচ্ছে। মানুষের জীবনধারা প্রভাবিত হচ্ছে সিনেমা, নাটক, টিভি চ্যানেলের দ্বারা। আগে বড়রা ঘরে ঢুকলে ছোটরা টিভি কিংবা স্টেরিও সেটের ভলিউম কমিয়ে দিতো কিংবা কখনও কখনও তা বন্ধ করে পড়ার ঘরে ছুটতো। বয়সে বড় মেহমানের সামনে ছোটরা যেতো না। এখন মূল্যবোধের পরিবর্তন হচ্ছে 'ফ্রিনেস' আর 'ফ্রিডম'-এর দাপটে। অল্প বয়সেই সব কিছুতে তর্ক করা কিংবা ভুল ধরিয়ে দেওয়া নতুন প্রজন্মের 'ফ্রিডম'। 'ফ্রিনেস' বেড়ে গেছে বলেই টিভিপর্দার সবকিছুই এখন মা-বাবার সঙ্গেই উপভোগ করছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। সন্তানরা মা-বাবার সঙ্গে আগের তুলনায় বেশি ফ্রি। আগে ছোটদের সুর্যাস্তের পর বাইরে থাকা বারণ ছিলো। এখন বহু স্কুল পডুয়া ছেলেমেয়ে ঘরে ফিরছে সন্ধ্যা ৭টা, ৮টার পর। ছোটরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে শিখেছে। আধুনিক যুগের এই নতুন দু'টি উপাদান 'ফ্রিডম' ও 'ফ্রিনেস' বদলে দিচ্ছে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরের মূল্যবোধ। এ প্রবণতা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর স্বাধীনচেতা মনোভাবের জন্ম দিচ্ছে সত্য, তবে একইসঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসময়োচিত এই 'ফ্রিডম', 'ফ্রিনেস' অশুভ পরিণতি বয়ে নিয়ে আসছে।

বাইরের পৃথিবীর নানা জ্বালা-যন্ত্রণা, অভাব-অভিযোগের বাইরে নিজের সদস্যদের নিয়ে ভেতরের পৃথিবী। এই পৃথিবীর প্রতিটি সদস্যই উন্মুখ একে অপরের ভালোবাসায় সিক্ত হতে। একক কিংবা একান্নবর্তী ধরনটা যাই হোক না কেন, সবাই চায় পরিবারটা হয় যেন সুখের সমুদ্র। যাতে ভাসবে আপন মানুষের সুখভরা প্রতিচ্ছবি। এ হবে এমন এক মরুদ্যান, যাতে সবাই খুঁজে পাবে অপার সুখের সন্ধান।

0 comments:

Post a Comment