RSS

Tuesday, July 21, 2009

জামদানি

বুননের নাম জামদানি। শিল্পের ভেতরের যে ঐশ্বর্য ছড়িয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্যে তার ধারক হয়ে আজো জনপ্রিয়তায় অনন্য হয়ে আছে জামদানি বয়ন। একসময় মসলিনের পরিপূরক হয়ে আমাদের ফ্যাশন ঐতিহ্যে বসতি গেড়েছিল জামদানি। ক্রমেই তা বাংলার তাঁতিদের আপন মমতায় আর সুনিপূণ দক্ষতায় হয়ে উঠে ঐতিহ্যের পাশাপাশি আভিজাত্যের পোশাক। জামদানির সেই গর্ব নিয়েই লিখেছেন মোর্শেদ নাসের টিটু

ভিন্ন জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের বয়ন শিল্প হিসেবে প্রাচ্যের বয়নশিল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল জামদানি মোটিভ। এই মোটিভে খুব সহজেই কাপড়ের ভেতর ছায়ার মাঝে তৈরি করা যায় নকশার প্রতিবিম্ব। মোটিভগুলো জ্যামিতিক আইন অনুসরণ করলেও তা শুধুমাত্র রেখা, চারকোনা কিংবা ত্রিভুজ নয় বরং তা দিয়ে ফুল, লতা-পাতা থেকে শুরু করে ফুটে উঠে নানা রকম ডিজাইন বিন্যাস। ঢাকার রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ এবং সিদ্ধিরগঞ্জে প্রায় ১৫৫টি গ্রামে এই শিল্পের বর্তমান নিবাস। অথচ এর যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেক প্রাচীন কালে। এটি মূলত বাংলার ঐতিহ্যের ধারক মসলিনের একধরনের প্রজাতি। তবে এর পাড় ও জমিনে অপেক্ষাকৃত মোটা সুতোয় বুননের মাধ্যমে ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয়। বর্তমানে বয়ন ধারায় জামদানি শাড়িতে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য করলেও মোঘল আমলে তা ব্যবহৃত হতো ‘আঙরাখা’ নামক বিশেষ পোশাক প্রস্তুতে। মূলত সেই সময়েই ইউরোপে জামদানির পৃষ্ঠপোষকতা শুরু হয়। পরবর্তীতে ইউরোপে গজ কাপড় হিসেবে জামদানি বুননের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। একসময় শুধুমাত্র গজ কাপড় হিসেবে বোনা হলেও পরবর্তীতে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে জামদানি শাড়িতে। বর্তমানে সালোয়ার কামিজ, ফতুয়া এমনকি হোম টেক্সটাইলেও জামদানি জনপ্রিয় অধ্যায় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জামদানির অন্যতম বড় শক্তি হচ্ছে এর বুনন কৌশল। পাশাপাশি জ্যামিতিক বিন্যাসে মোটিভ ফুটিয়ে তোলায় জামদানি এক অন্যতম সৃষ্টিশীল তাঁত অধ্যায়। এই বুননের সঙ্গে তুরস্ক আর নেপালের ভিন্নমাত্রার বুননের কিছুটা মিল থাকলেও জামদানি শিল্প যেন এক স্বতন্ত্র অধ্যায়। অতীতের সেই উৎকর্ষ হারিয়ে আজ জামদানি অনেক বেশি সাধারণ পর্যায়ে নেমে এসেছে। তাঁতিদের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এই শিল্পের গৌরবময় নিপূণতাকে নষ্ট করেছে। এর মৌলিক ডিজাইন শক্তি যে পরিমাণ অর্থনৈতিক বুনিয়াদে গড়ে উঠা প্রয়োজন তার অভাবে এই গুণাগুণ নষ্ট হয়েছে। ফলে সঠিক বাজার আর শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে জামদানি তার আপন ঐতিহ্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে জামদানি শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও তা শুধু বাণিজ্যিক প্রচারেই ব্যস্ত। ফলে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজন সঠিকভাবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে পারেন না। তাদের অভাব অনটন আর বাস্তবতা সত্যিকার শিল্প ও জামদানির ঐতিহ্যকে প্রকৃতভাবে লালন করার সুযোগ থেকে বঞ্চি করছে। শুরু থেকেই জামদানি বুননে মূল নকশাগুলোতে বিভিন্ন রঙের সমাহারে বিশেষ মায়া তৈরি করা হতো। ফলে উজ্জ্বল রঙ যেমন প্রাধান্য পেত তেমনি নানা রকম ভেষজ রঙের মিশ্রণে সফট টোনের কালারও মূখ্য হয়ে উঠতো। রঙের এই বিন্যাসে জামদানি বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা পায়। কেননা জামদানির রঙ মিশ্রণের অনুপাত ও স্থায়িত্যের কলাকৌশল বিভিন্ন রঙের সুতা তৈরিতে অবদান রেখেছে। আগে সুতা ও রেশম ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে জামদানির বুননে র’ সিল্ক, সুতির সুতা এবং নাইলন ব্যবহৃত হচ্ছে। মনে রাখা প্রয়োজন জামদানি বুননের মূল শক্তিই সুতা। এই সুতার সুক্ষতার উপরই নির্ভর করে জামদানি কাপড়ের মান ও গুণাগুণ। আর সুতার সুক্ষ্মতা নির্ভর করে সুতার তৈরির তুলা ও কাটুনীর দক্ষতার উপর। প্রাচীনকাল থেকেই এই ধরনের কাপড় তৈরির জন্য শীতলক্ষা নদীর পাড় বরাবর পুরাতন সোনারগাঁ অঞ্চলটিই ছিল ব্যাপক উৎপাদন কেন্দ্র। তখন জামদানি বয়ানে একমাত্র মুসলিম কারিগররাই ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। বর্তমানেও মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকই এই শিল্পের দক্ষতার সঙ্গে জড়িত। একটি জামদানি কাপড় বুনতে প্রতিটি তাঁতে দু’জন করে কারিগর থাকেন। এদের একজন দক্ষ কারিগর, তার পদবী মূল কারিগর। অপর একজন মূল কারিগরের সহয়তাকারী শিক্ষানবীশ বা সাগরিদ। একজন জামদানি শিল্পী প্রকৃত অর্থেই শিল্পী। বহু মেধা ও শ্রমের সাথে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে জামদানি সে তৈরি করে অন্যের ব্যবহারের জন্য, অন্য এক রমনী যাকে হয়তো সে দেখেনি কোনদিন তাকেই করে তোলার চেষ্টা করে আকর্ষণীয়া। এভাবেই এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজন জামদানিকে করে তুলেছে আজো আভিজাত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বয়ন। জামদানি আজ শুধুমাত্র আমাদের ঐতিহ্য নয় বরং আমাদের আগামী দিনের গৌরব। বাংলাদেশের তাঁতিদের শ্রম, স্বপ্ন, অধ্যাবসায় আর চেষ্টার সঙ্গে আগামী দিনে নতুন কোন পৃষ্ঠপোষকতার অধ্যায় যুক্ত করতে পারলেই জামদানি বিশ্বজুড়ে আমাদের মানচিত্রকে গর্বিত করবে আলাদা করে। যার ফলে আমরা আপন ঐতিহ্য আরো বেশি আকৃষ্ট করবে আমাদের বয়ন শিল্পের গৌরবকে বিশ্বমানচিত্রে পৌঁছে দিতে। সেই সুদিন যেন খুব বেশি দূরে না থাকে সেই চেষ্টাই করা উচিত।

0 comments:

Post a Comment