RSS

Sunday, May 16, 2010

 আশা-ভরসায় পরিবার

পাড়ার বখাটে ছেলের বাজে কথার প্রতিবাদ করেছিল কিশোরীটি। জবাবে আরও বাজে কথা আর চড় খেতে হলো সেই ছেলের কাছে। দুঃখী, অভিমানী কিশোরীটি একটু ভরসা করার, কাঁধে মাথা রেখে একটু কাঁদার মতো কাউকে পায়নি। ছেলেটার ওপর না যত, তার চেয়ে বেশি হয়তো গোটা পৃথিবীর ওপর অভিমানে বিষ খেয়ে, তাজা জীবনটার ইতি ঘটিয়ে দিল সে। পাঠক, এ গল্প তো আপনি হামেশা পড়ছেন পত্রিকায়।
ফলোআপ নিউজে পড়ছেন সেই বখাটে কিশোর কেমন ছিল, ভালো মা-বাবার সন্তান হয়েও যে কিনা লেখাপড়া ছেড়ে বখাটে হয়েছে, হয়তো নাম লিখিয়েছে মাদকগ্রহণকারীদের দলেও। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি সমাজে কেন সৃষ্টি হচ্ছে বখাটে, মাদকাসক্ত, সন্ত্রাসী বা নারীর উত্ত্যক্তকারী? কেন তাদের উৎপাত সইতে না পেরে আত্মঘাতীহচ্ছে প্রাণোচ্ছল কিশোরী?

এখন পরিবার মানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হলো নিউক্লিয়ার বা ছোট পরিবার, পাশ্চাত্যে আরও ছোট হয়ে যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ওয়ান-প্যারেন্ট ফ্যামিলি বা একক অভিভাবকের পরিবারে। কিন্তু এর ধাক্কাটা গিয়ে পড়ছে মানুষ ও সমাজের মনোজগতে। পরিবার ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ছে মূল্যবোধ, হাজার বছরের সংস্কার ও বন্ধন। ধসে পড়ছে পারস্পরিক যোগাযোগ, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার অভ্যাসটাও। কিন্তু এ ভেঙে পড়া কীভাবে ঠেকানো যাবে না? কীভাবে আমরা টিকিয়ে রাখতে পারি আমাদের পরিবারের স্নেহময় পরিবেশ? কীভাবে পরিবার আজকের দিনেও হয়ে উঠতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা? বিশ্ব পরিবার দিবস সামনে রেখে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।

ভরসার জায়গাজমি
সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এইচ এম কিশয়ার হোসেন-এর মতে, আজকের নিউক্লিয়ার পরিবারে মা-বাবাও দারুণ ব্যস্ত। ফ্ল্যাটগুলোতে বাচ্চারা মানুষ হচ্ছে একা একা, হয় কাজের লোকের কাছে অথবা নেহাত টিভি-কম্পিউটার দেখে। সেখানে ওরা মা-বাবার চেয়ে আলাদা তো হবেই। স্কুলগুলোও একগাদা পড়ার চাপ আর বাড়ির কাজ চাপিয়ে দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করছে। আর বন্ধু-সঙ্গীর অবস্থাও একই রকম। তাই হঠাৎ একদিন মা-বাবা আবিষ্কার করছেন যে তাদের ছোট্ট যে শিশুটি আঁচলের তলা থেকে সরতে চাইত না, সে আজ সত্যি অনেক দূরে সরে গেছে। তাকে আর চেনা যাচ্ছে না। তার অভিমান, তার দুঃখ, এমনকি তার আনন্দ, খুশি—কোনোটাই আর ছুঁতে পারছেন না তাঁরা। দূরত্ব এভাবেই তৈরি হয়। কিন্তু এ দূরত্ব ভাঙার উপায় কী? কিশয়ারের মতে, উপায় আছে। আজকের এ প্রতিযোগিতার দিনে মা-বাবারা ব্যস্ত থাকবেন সত্যি, কিন্তু ব্যস্ত থেকেও সর্বদা কেমন করে সন্তানের কাছে থাকা যায়, তার অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। যেটুকু সময় কাছে পাওয়া যায়, তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি বিষয় শেয়ার করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আর এ সহমর্মিতা বা শেয়ার করার চর্চাটা বাড়িতে চালিয়ে যেতে হবে ছোটবেলা থেকে বড়বেলা পর্যন্ত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ঝুনু শামসুন নাহার পরিমাণগত নয়, বরং সন্তানদের সঙ্গে অতিবাহিত সময়ের গুণগত মানের দিকে বেশি জোর দিয়েছেন। যে সময়টুকু আমরা পরিবারে দিই না কেন, তা যেন হয় প্রাণবন্ত, আনন্দময়, সুস্থ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। খাবার টেবিলে, একসঙ্গে টিভিতে খেলা দেখার সময় বা ঘুমানোর আগের ছোট্ট সময়টুকুও কাজে লাগানো যেতে পারে। পারিবারিক মুহূর্তগুলো একসঙ্গে উপভোগ করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। ‘এসো না আমরা একসঙ্গে খেলা দেখি’ বলে বাবা অনেকটা সময় কাটাতে পারেন সন্তানের সঙ্গে। কিংবা অনেক রাতে কিশোরী মেয়ে কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললে চটে না গিয়ে মা বলতে পারেন, ‘কার সঙ্গে কথা বলছ, মা, এই বন্ধুটাকে একদিন নিয়ে আসো না বাড়িতে, পরিচয় হোক।’ যে জিনিসটা আমাদের পছন্দ নয়, যা আমাদের মূল্যবোধের বাইরে, সন্তানকে তা করতে দেখে রুষ্ট হলেও তার প্রকাশভঙ্গিটা এ রকম হলেই ভালো। ‘বিদেশি ছবি দেখো না, ওসব খারাপ—এ কথা না বলে বলা যায় যে বিদেশি সবকিছুই খারাপ নয়, বরং ওতেও অনেক সময় অনেক ভালো কিছু দেখায়। তুমি বরং ভালোটা দেখো, খারাপটা এড়িয়ে চলো।’
সবচেয়ে বড় কথা, যে মূল্যবোধে আমরা সন্তানদের বড় করে তুলতে চাই, সেটার নিজেদেরও চর্চা করতে হবে। কেননা, দেখে দেখেই মানুষ সবচেয়ে বেশি শেখে। সন্তানকে বলছেন, মারামারি করো না, অথচ নিজে কাজের লোককে মারছেন। অথবা সন্তানকে বলছেন, বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি করতে নেই, অথচ নিজেরা বুড়ো মা-বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন। এ শিক্ষার প্রায়োগিক সম্ভাবনা কম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সন্তান যেন আকস্মিক, হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে না ফেলে, সে জন্য তার প্রতিটি বিষয় শেয়ার করতে পারার মতো বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করুন বাড়িতে। পারিবারিক পরিবেশে সন্দেহ, চাপিয়ে দেওয়া মনোভাব ও অগ্রহণযোগ্যতা থাকলে তা শিশুর মনে কোনো কিছু শেয়ার করার পরিবর্তে বৈরী মনোভাব গড়ে তোলে।

সুস্থ পারিবারিক মূল্যবোধের চর্চা
মনমানসিকতার ব্যাপক পার্থক্য ও প্রজন্ম-ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও কীভাবে পরিবারে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা যায়, সে জন্য মনোবিদদের রয়েছে কিছু পরামর্শ।
এক. ব্যস্ততা সত্ত্বেও পরিবারের সবাই মিলে দিনের কোনো একটি সময় একসঙ্গে কাটান। সেটা রাতের খাবার টেবিলে হতে পারে, শোয়ার আগে বসার ঘরের ছোট্ট বৈঠক হতে পারে, হতে পারে এমনকি গাড়িতে স্কুল-কলেজ-অফিসে যাওয়ার পথেও। বাইরে থেকে এসে মুখ গোমরা করে টেলিভিশন দেখতে না বসে অভিভাবকেরা একবার ছেলেমেয়ের ঘরে উঁকি দিন, খোঁজ নিন ওদের দিনটা কেমন গেল, কী কী ঘটল—সবকিছু কেমন চলছে।
দুই. সন্তানের সঙ্গে সব সময় হুকুম-শাসনের ভাষায় কথা না বলে স্নেহ-ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের স্বরে কথা বলুন। ছোট্টবেলায় ওদের যেমন করে আদর-সোহাগ করতেন, বড়বেলায় তা অনেকটা বেখাপ্পা মনে হলেও আচরণে সেই আদর যে এখনও অটুট আছে, তা বুঝিয়ে দিন।
তিন. সন্তানের পড়াশোনা, মেলামেশা ও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রগুলোর সঙ্গে নিজেকেও যুক্ত রাখুন। তার বন্ধুদের বাড়িতে ডাকুন, কথা বলুন, ওদের বুঝতে চেষ্টা করুন, এমনকি ওদের পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলুন। এতে করে আপনার সন্তানকেও বেশি করে জানা-বোঝা হবে।
চার. যে অভ্যাস যে মূল্যবোধগুলো সন্তানের মধ্যে আপনি দেখতে চান, সেগুলো প্রায় হাতেকলমে শেখান। যেমন, আপনি বই পড়তে ভালোবাসেন, তাই ছোটবেলা থেকে সন্তানকে বই উপহার দিন, বইমেলায় নিয়ে যান, বইয়ের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন। আপনি বয়স্ক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে যাওয়ার সময় ওকেও সঙ্গে নিয়ে যান, দেখিয়ে দিন বয়স্কদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয়।
পাঁচ. ছেলেমেয়ের ক্ষেত্র থেকেও করণীয় আছে অনেক। তাদেরও বুঝতে হবে যে মা-বাবারা আসলে তাদের ভালোটাই চান। হয়তো সব সময় তাদের প্রকাশভঙ্গি সঠিক থাকে না। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, মা-বাবা এত স্নেহ আর ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন বলেই আমরা আজ এখানে।
ছয়. অনেক সময় প্রজন্ম-ব্যবধান ভাঙতে ছেলেমেয়েদেরও এগিয়ে আসতে হয়। পুরোনো ধ্যান-ধারণার যে বাবা ছেলে-মেয়ের ভিন্ন লিঙ্গের বন্ধুত্বকে চিরকাল সন্দেহের চোখে দেখেছেন, সেই বাবাকে দেখিয়ে দিতে পারেন যে ছেলে-মেয়ের মধ্যেও নির্মল বন্ধুত্ব হওয়া সম্ভব। বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে সময় কাটানো মানেই যে খারাপ কিছু নয়, তাও প্রমাণ করে দিতে পারেন কখনো নিজেদের আড্ডায় অভিভাবককে সামান্য অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে।
সাত. পরস্পরের সাহচর্য উপভোগ করতে শিখুন। পরিবার যেন কারও হাঁসফাঁস করার মতো বা বিষণ্ন হয়ে পড়ার মতো না হয়ে ওঠে। পরিবার বা ঘর হবে এমন, যেখানে পা দেওয়া মাত্র পৃথিবীর সমস্ত জঞ্জাল, জীর্ণতা আর বিষণ্নতা ভুলে গিয়ে শান্তি, স্বস্তি ও সৌহার্দ্যে মনটা ভরে উঠবে।

আমরা কী কী হারাতে চাই না
আমরা হয়তো হারিয়েছি অনেক, হেরেছিও অনেক। প্রত্যেকের জীবনেই আছে এসব পরাজয়, ক্লান্তি আর দীনতার গল্প। কিন্তু কিছু কিছু জিনিস আমরা কিছুতেই হারাতে চাই না। হারাতে চাই না মায়ের কোমল হাতের পরশ, বাবার চশমার ফাঁকে স্নেহময় চোখ, হারাতে চাই না একসঙ্গে আড্ডা দিতে বসে হো হো করে হেসে ওঠা, ঝুমবরষায় বৃষ্টি দেখে দেখে একসঙ্গে মুড়ি-চানাচুর খাবার স্মৃতি; চাই না হারাতে ঈদে-নববর্ষে-জন্মদিনে হাত পেতে নেওয়া বড়দের আশীর্বাদ; আমরা হারাতে চাই না আকাশের ভেতরে যে আরেক আকাশ আছে—আমাদের ঘর, আমাদের পরিবার। কেননা, এটাই আমাদের আসল আকাশ, আসল আশ্রয় ও ঠিকানা।

0 comments:

Post a Comment