RSS

Wednesday, October 13, 2010

সময়ের কাজ সময়ে

সারা দিন যেন কেটে যায় নানা কাজে। দম ফেলার ফুসরত নেই। আর এসবের মধ্যে নিজের জন্য একটু সময় রাখার কথা তো ভাবাই যায় না। কর্মজীবী মেয়েদের জীবনটা যেন এমনই। তবে একটু বুঝে সময়ের সঠিক ব্যবহার করলেই কিন্তু এ পরিস্থিতি এড়ানো যায়। সে জন্য প্রয়োজন পরিবারের সবার আন্তরিক সহযোগিতা ও সঠিক পরিকল্পনা।

ভাগ করে নিন কাজটাকে
‘সারা দিনের কাজের একটা তালিকা করি। এবার কোন কাজ কখন হবে, সেভাবে তা মেনে চলি। আর কাগজে-কলমে পরিকল্পনা না করলেও মনে মনে তো সাজানোই থাকে।’ বললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহনাজ চৌধুরী। একই সঙ্গে তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ উপস্থাপনার কাজও করেন। সারা দিন কাজের পরিকল্পনা কীভাবে করেন, তা জানালেন তিনি। ‘যেহেতু আমাকে একসঙ্গে অনেক কাজ করতে হয়, তাই রুটিন মোতাবেক চলি। রাতেই ঠিক করে ফেলি, পরদিন কোন পোশাক পরব। আনুষঙ্গিক জিনিসও গুছিয়ে রাখি। আমি পোশাকের সঙ্গে সব অনুষঙ্গ মিলিয়ে পরতে পছন্দ করি। সে কারণে পূর্বপ্রস্তুতি লাগে। সন্তানেরা সকালে স্কুলে কী টিফিন নিয়ে যাবে, তা রাতেই ঠিক করি। বাড়ির কাজের সহকারীকে বুঝিয়ে দিই, পরদিন খাবারের পদ কী হবে। তাহলে সকালে সময় অনেকখানি বেঁচে যায়। সকালে ছেলেরা নিজেরাই স্কুলে যায়। আমরা স্বামী-স্ত্রী বেরিয়ে পড়ি কাজে।
অনেক সময় তাড়াহুড়োয় ঘরে তৈরি হতে না পারলে গাড়িতে বসেই নিজেকে সাজিয়ে নিই। যানজটের কারণে গাড়িতে বেশ কিছুটা সময় কাটাতে হয়। সেটাকে কাজে লাগালে সময়ক্ষেপণ কম হয়। আমাকে যেহেতু পড়াশোনা করতে হয়, তাই গাড়িতে কয়েকটা বই রেখে দিই। গাড়িতে উঠেই পড়তে বসি। একেক কাজের ক্ষেত্রে পোশাক ও সাজসজ্জা একেক রকম হয়। সেভাবেই নিজেকে তৈরি করি। যেদিন সন্ধ্যায় কাজ থাকে, আগেই তা বাসায় জানিয়ে রাখি। আমার স্বামী-সন্তানেরা সেভাবে প্রস্তুতি নেয়। তখন হয়তো স্বামী ওদের লেখাপড়াটা দেখে। ওদের সঙ্গে বেশি সময় কাটায়। আমি যেদিন বাসায় থাকি, বিকেলে সেদিন সন্তানদের জন্য খাবার তৈরি করি। এতে ওদের সঙ্গে একধরনের সৌহার্দ্য বাড়ে। সংসারের সব দিকে খোঁজখবর নিই। হয়তো আগামী দুই দিনের খাবারের তালিকা করে দিই। আর ছুটির দিনে অন্যান্য কাজ করি। সবারই যখন ছুটি থাকে, তখন বাইরে কোথাও ঘুরতে যাই।’
শাহনাজ চৌধুরী নিজের সময় বাঁচাতে কিছু কৌশল অবলম্বন করেন। তা হলো—
 কার কী প্রয়োজন, রাতের খাবার টেবিলে তা আলোচনা করা। অন্তত রাতের খাবারটা একসঙ্গে খাওয়া উচিত।
 সপ্তাহে একদিন কেনাকাটা সেরে ফেলা। প্রতিটি কাজের জন্য নির্দিষ্ট দোকান থাকলে ভালো হয়। যেমন—দর্জির দোকান। মাপমতো পোশাক পাঠিয়ে দিলেই বা ফোন করে দিলেই তারা পোশাক বানিয়ে রাখতে পারে। প্রসাধন সামগ্রীর দোকান নির্দিষ্ট থাকলে কোনো কিছু দরকার হলে ফোন করে নিশ্চিন্ত হলেন। পরে কোনো এক ফাঁকে গিয়ে কিনে আনলেন।
 হয়তো অফিস থেকেই কোনো অনুষ্ঠান বা দাওয়াতে যেতে হবে। তখন এমন পোশাক বাছাই করুন, যা দুই জায়গায় পরা যাবে। আর দু-তিনটি ব্যাগে মেকআপসামগ্রী রাখুন। কারণ এক ব্যাগ থেকে আরেক ব্যাগে নিতে অনেক সময় মনে থাকে না। এতে ঝটপট গাড়িতে বসেই তৈরি হতে পারবেন। চিরুনি, ফাউন্ডেশন, কাজল, লিপস্টিক, ফেসওয়াশ, ওয়েট টিস্যু, কমপ্যাক্ট পাউডার রাখুন।
 গাড়িতেই পছন্দের কোনো গান শুনতে পারেন। মনটা ফুরফুরে হয়ে যাবে।
 কাউকে নিমন্ত্রণ করতে চাইলে পরিবারের সবার সঙ্গে আলোচনা করে নিতে পারেন। এতে সবার সহযোগিতা পাবেন।
 যখন যে কাজ করবেন, তাতেই পুরো মনোযোগ দিন। আর প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করুন। দেখবেন, কোনো ধরনের চাপ অনুভব করবেন না।

সন্তানকেও হতে হবে স্বাবলম্বী
‘কর্মজীবী নারীদের সন্তানকে ছোট থেকেই একটু একটু করে স্বাবলম্বী করতে হবে। মা কত কাজ করেন, তা গল্পচ্ছলে তাদের বোঝাতে হবে। তবে তাদের সঙ্গেও পর্যাপ্ত সময় কাটাতে হবে। এতে করে তারা আপনার ব্যস্ততা বুঝবে।’ এমনই মনে করেন ব্র্র্যাক ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান তাহনিয়াত আহমেদ করিম। সন্তান স্বাবলম্বী হলে সে নিজেই অনেক কাজ করতে পারবে, যা আপনার সময় বাঁচিয়ে দেবে। আপনার অনুপস্থিতিতে ওর কোনো অসুবিধা হবে না। ‘মাঝেমধ্যে আমার বড় ছেলেকে বলি কফি বানিয়ে আনতে। ও খুব আগ্রহ নিয়ে আমার জন্য কফি বানায়। এতে ও একটা কাজ শিখল। আমাদের সম্পর্কটাও গাঢ় হলো। সন্তানকে আমি কখনো স্কুলে নামিয়ে দিই না। ওরা নিজেরাই যায়। তবে যেসব মা-বাবা একসঙ্গে কাজে বের হন, তাঁরা সমঝোতা করে নিন। যিনি আগে তৈরি হবেন, তিনিই সন্তানকে তৈরি করুন। পথে স্কুল পড়লে নামিয়ে দিন। এভাবে দুজনেরই সময় বাঁচবে।’
সন্তানকে নিজের হাতে খাওয়ার অভ্যাস, নিজের কাপড় গুছিয়ে রাখা—এ অভ্যাসগুলো তৈরি করুন। এতে ভবিষ্যতে তারই সুবিধা হবে। মুঠোফোন তো রয়েছেই। সময়মতো খোঁজখবর নিতে পারবেন। তবে চেষ্টা করবেন বাড়িতে ফিরে মুঠোফোনের ব্যবহার যতটা সম্ভব কমাতে। এতে সন্তানেরা অনেক সময় বিরক্ত হয়।

নিজের জন্য কিছুক্ষণ
সারা দিনের কাজের পর অনেক সময়ই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তা কাটানোর উপায় কী! তাঁদের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন রূপবিশেষজ্ঞ রাহিমা সুলতানা। তিনি বলেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে নিজের কথা। আপনি চাইলেই সময় বের করতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন ইচ্ছা। নিজস্ব কিছু অভ্যাস সবারই থাকে। কেউ কেউ গোসল না করে সকালে বের হন না। শতব্যস্ততায়ও এ সময়টা তিনি বের করে নেন। তেমনিভাবে বেশি অস্বস্তি হলে বাড়িতে ফিরেও গোসল করতে পারেন। তবে ঠান্ডার সমস্যা থাকলে না করাই ভালো।
 বাড়িতে ফিরেই বেশি পানি দিয়ে হাত, মুখ, পা ও ঘাড়ের পেছন ভালোভাবে মুছে নিন। চাইলে কুসুমগরম পানিতে কোনো সুগন্ধী মিশিয়ে তোয়ালে ভিজিয়ে শরীর মুছে নিন, বিশেষ করে ঘাড়ের পেছনের অংশ। এতে করে অনেকখানি ক্লান্তি কমে যাবে।
 তেল বা ক্লেনজার দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে নিন। ছুটির দিনে তৈলাক্ত ত্বকের জন্য মধু ও তেঁতুলের রস দিয়ে ক্লেনজার তৈরি করে কাচের পাত্রে করে ফ্রিজে রাখুন। আর সাধারণ ও শুষ্ক ত্বকের জন্য তৈরি করুন দুধ ও মধুর মিশ্রণ। সপ্তাহে একদিন বিউটি পারলারেও যেতে পারেন। মুখ, চুল ও হাত-পায়ের পরিচর্যা করে ফেললেন। মাসে একবার ফেসিয়াল, শরীর মালিশ বা স্পা করিয়ে নিন। এতে শরীর ও মনের ক্লান্তি দূর হবে।
 সকালে ১০ মিনিট যোগব্যায়াম করা উচিত। এতে করে সারা দিন মন ভালো থাকবে। গাড়িতে বসেও প্রাণায়াম করতে পারেন। বেশি ক্লান্তি লাগলে ১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকুন।
 রাতে ঘুমানোর আগে সপ্তাহে অন্তত চার দিন আধা ঘণ্টা যেকোনো ধরনের ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করা উচিত।

গোছানো রান্নাঘর
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফিরোজা সুলতানা বলেন, কর্মজীবী নারীরা তিনবেলা রান্না করার সময় পান না। বাড়িতে রান্না করার লোক না থাকলে আগের রাতেই পরদিন সকাল ও দুপুরের রান্না করে রাখুন। সময় বাঁচাতে ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, রাইস কুকার, ব্লেন্ডার, মিক্সার, টোস্টার, ওয়াশিং মেশিন, প্রেসার কুকার এসব যন্ত্রপাতি কিনুন। এতে আপনি দ্রুত রান্না করতে পারবেন। রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি হাতের কাছে রাখুন। অনেক পদের রান্না না করে তিনটি পদ রান্না করুন। তবে তা যেন পুষ্টিকর হয়। ভারী কাজগুলো ছুটির দিনে করুন। ঘর গোছানোর কাজ পরিবারের সবাই মিলে করুন। এতে সময় বাঁচবে, চাপও পড়বে না।
আসল কথা হলো সব কাজের দায়িত্ব নিজের ওপর নেবেন না। কিছু কাজ সবার মধ্যে ভাগ করে দিন। এতে করে পরিকল্পনামাফিক সব কাজ ঠিক সময়ে শেষ করতে পারবেন।

0 comments:

Post a Comment