RSS

Tuesday, October 26, 2010

ছোটদের সামনে বড়দের আচরণ

আড্ডায় বড়দের মধ্যে চলছে নানা আলাপ। অন্যের সমালোচনাও। চিৎকার করে মা-বাবা ঝগড়া করছেন। ফোনে বন্ধুকে বলছেন অশালীন কথা। খাবার টেবিলে বসে কাজের লোককে ধমক দিচ্ছেন। টিভিতে দিনমান দেখছেন নাটক, সিনেমা। তবে বাড়িতে কিন্তু ছোট শিশু আছে। তার সামনেই চলছে এসব। আমরা ভাবছি ও তো ছোট, এসব বুঝবে না। কিন্তু শিশুর মনের ওপর এসবের কী প্রভাব পড়ছে, তা কি ভেবে দেখেছি আমরা? আমরা অসচেতনভাবেই ছোটদের সামনে এমন অনেক আচরণ করে থাকি। বড়রা বেশির ভাগ সময় খেয়াল করি না, ছোটরা এসব আচরণ ধারণ করছে। তা থেকেই পরে নানা সমস্যা দেখা দেয়।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের চাইল্ড নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক নায়লা জামান খান বলেন, ‘আমাদের নিত্যদিনের অভ্যাসগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা না বুঝেই শিশুদের সামনে অসংগত আচরণ করে ফেলি। প্রত্যেক মানুষের ত্রুটি আছে। কিন্তু শিশু যে বয়সে শেখে, সে সময়ে তার সামনে এসব যেন প্রকাশ না পায়। এই যেমন: শিশুদের সামনে হয়তো অনেকক্ষণ ধরে টিভি দেখা হচ্ছে। প্রায় সময়ই দেখা যায়, তা শিশুতোষ না। মা-বাবা দেখার কারণে শিশুটিও তা দেখছে। শিশুটি কিন্তু বড়দের মতো করে বুঝতে পারছে না যে টিভিতে যা দেখাচ্ছে, তা অবাস্তব। তার কাছে সেটিই জীবনের অংশ। প্রাপ্তবয়স্কদের নানা অনুষ্ঠান, নাটক তাকে সহজেই প্রভাবিত করছে। মারামারির দৃশ্য, হিংসা, মিথ্যা বলা থেকে শুরু করে আপত্তিকর দৃশ্যগুলো তাকে আকর্ষণ করছে। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও এগুলোর ভিত্তিতে গড়ে উঠছে। তাই বলে পরিবারের লোকজন টিভি দেখবে না, তা নয়। দেখবে, শিশু যখন সামনে থাকবে না তখন। রাত ১০টার মধ্যে শিশুকে অবশ্যই ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। তারপর টিভি দেখা যেতে পারে।
‘এ ছাড়া মা-বাবা যদি সারাক্ষণ টিভি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। শিশু এতে নিজেকে গুরুত্বহীন ভাবতে পারে। শিশুকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগও মা-বাবা পান না।
‘শিশুদের সামনে বাসার কাজের লোকটিকে হয়তো মারধর বা গালি দেওয়া হয়। এতে শিশুটি তা শিখে ফেলে। হিংস্রতা তার চরিত্রে ঢুকে পড়ে। দেখা গেল সেও গালিটি রপ্ত করে ফেলেছে। এসব ছোট বিষয়ের প্রতি সচেতন হতে হবে বড়দের।’
‘পাশের ঘরে শিশুটি। শোনা যাচ্ছে মা-বাবার ঝগড়া। একটু পর মারের শব্দ। আঁতকে ওঠে শিশু। সেই শিশুটি একসময় বড় হয়। দেখা যায় তার আচরণগত সমস্যা। সেও বাবার মতো তার স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করে। বাস্তব জীবন থেকেই এই উদাহরণ দিলাম।’ কথাগুলো বলছিলেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিশুবিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোরশেদা বেগম।
মোরশেদা বেগম আরও বলেন, ‘শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। ভালোমন্দ বিচার করতে পারে না। সে কারণে তাদের সামনে সব কথা নম্রভাবে বলা উচিত। বড়রা যা বলবেন, সে তা-ই বিশ্বাস করবে। তাই তাকে কিছু বলা বা তার সামনে আচরণ করার সময় কিছু বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
কখনোই শিশুর সামনে কারও সমালোচনা করা উচিত নয়। সন্তান পাশে খেলছে। আপনি বসে গল্প করছেন কিংবা ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। সে সময় কাউকে নিয়ে কটূক্তি বা মন্তব্য করে বসলেন। আপনি হয়তো ভাবলেন ছোট হওয়ায় ও হয়তো বুঝবে না। কিন্তু আপনার কথা বা আচরণ তো সে শুনল, দেখল। এতে সেই ব্যক্তিটি সম্পর্কে তার খারাপ ধারণা হবে। না বুঝে সেই ব্যক্তির সামনে সে বলতেই পারে। তখন আপনাকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে। সন্তানের অনুপস্থিতিতে একান্ত কথা কাউকে বলতে পারেন।’
‘বিশেষ দিনে বা অনুষ্ঠানে প্রায়ই আমরা উপহার পেয়ে থাকি। পছন্দ না হলে বা না বুঝেই সেটি নিয়ে মন্তব্য করি। পরে দেখা যায় শিশুটিও তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। বড়দের সামনে তা বলেও ফেলে। তখন কিন্তু মা-বাবা তাকে শাসন করেন। তাঁদের নিজেদের আচরণের কারণে যে ওই শিশুটি সেসব শিখে ফেলেছে, সেটি তাঁরা তখন বোঝেন না।
মা-বাবার মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ বা কথাকাটাকাটি বা ঝগড়া হলে তা শিশুর সামনে প্রকাশ না করাই ভালো। তার অনুপস্থিতিতে এ নিয়ে আলোচনা করাই ভালো। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সমালোচনা সন্তানের সামনে করেন। এতে তাঁদের সম্পর্কে সন্তানের বিরূপ মনোভাব গড়ে উঠতে পারে।
প্রতিবেশীকে নিয়েও কোনো কথা সন্তানের সামনে বলবেন না। বললে সেই পরিবার বা ব্যক্তিটি সম্পর্কে তার মনে ভিন্ন ধারণা তৈরি হবে। পরে সে তাকে শ্রদ্ধা করবে না। সুতরাং কোনো নেতিবাচক আচরণ বা কথা শিশুর সামনে বলা যাবে না। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এসব আচরণও তার মধ্যে গেঁথে যাবে। এতে নৈতিক অবক্ষয় ঘটে। ফলে কিশোর অপরাধসহ সামাজিক অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে।’ বলেন মোরশেদা বেগম।
শিশুদের নিয়ে কাজ করছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেন। এখানকার উন্নয়নকর্মী কাজী এমদাদুল হক মনে করেন, ‘শিশুকে সব সময় গুরুত্ব দিতে হবে। তার জন্য সুরক্ষিত ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত। আমরা শিশুর সামনে গুরুজন বা শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের সমালোচনা করি। এমনকি পরিবারের কোনো সদস্য সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যও করে ফেলি। এতে শিশুটি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে না, তার কী করা উচিত। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সে হারিয়ে ফেলে। তার কোনো বন্ধু, স্কুলের সহপাঠী বা প্রতিবেশীর সন্তানের আচরণ নিয়েও তার সামনেই কথা বলি। এতে পরে সে বন্ধুত্বপরায়ণ হবে না। কেননা, তার সঙ্গে হয়তো সে মিশবে না। বিত্ত-সামর্থ্যের প্রসঙ্গও বড়দের আড্ডায় চলে আসে। ফলে শিশুর মধ্যে শ্রেণী-বৈষম্য আচরণ প্রকাশ পাবে। সামাজিকীকরণ থেকে সে বঞ্চিত হবে। অনেক সময় সাম্প্রদায়িক কোনো মন্তব্যও তার সামনে করে ফেলি। কোনো বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠী নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করি। এগুলোও করা ঠিক নয়।’
এ ছাড়া শিশুদের সামনে অন্যকে অবহেলা, উপেক্ষা বা অন্যের সাফল্যকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। এসব আচরণ সে রপ্ত করে ফেলবে। শিশুটির মধ্যে মানবিকতা কমে যাবে। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে। তাই অন্যের সামাজিক, সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজের প্রশংসা করুন ওর সামনে।
তবে তাই বলে কি আপনি বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় মাতবেন না? বা পছন্দের অনুষ্ঠানটি দেখবেন না। মোটেও তা নয়। কিন্তু আগে লক্ষ করুন, শিশুটি কী করছে, কোথায় আছে। যেমন শিশু যখন স্কুলে গেছে, বিকেলে বাইরে খেলতে গেছে, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমিয়ে গেছে—এমন সময়টা আপনি নিজের মতো করে কাজে লাগান। নিজের একান্ত মুহূর্ত, বিনোদনেরও প্রয়োজন আছে। তবে সেই সময়টা যাতে শিশুর ওপর কোনো প্রভাব না ফেলে।
আপনার ছোট আচরণের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সন্তানের বিকাশ সঠিকভাবে হবে। এ জন্য প্রয়োজন আরেকটু সচেতনতা।

0 comments:

Post a Comment