RSS

Friday, July 22, 2011

সচেতন হতে হবে অভিভাবককে

১১ বছর বয়সী প্রতীক (ছদ্মনাম) বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তার খুব আগ্রহ ফেসবুক নিয়ে। কিন্তু বাবা প্রতীককে ফেসবুকে নাম লেখাতে দিচ্ছেন না। কেননা ১৩ বছর বয়সের আগে সামাজিক যোগাযোগের এই ওয়েবসাইটের সদস্য হওয়া যায় না। এদিকে প্রতীকের কয়েকজন সহপাঠী নিজেদের বয়স বাড়িয়ে রীতিমতো বিচরণ করছে ফেসবুকে। সেই সহপাঠীদেরই একজন আরেকজনকে ফেসবুকে আপত্তিকর কথা লিখে দিয়েছে। যাকে লিখেছে সে প্রতীকের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’। এটা শুনে প্রতীক ওই ছেলেকে স্কুলে রীতিমতো হুমকি দিয়ে বসেছে। ফলে প্রতীকের অভিভাবককে তলব করা হয় স্কুলে।

কলগুলো আসত লাবণীর (ছদ্মনাম) মোবাইল ফোনে। সারা দিনে অজস্র এসএমএস। ১২ বছরের লাবণীর ফোনে চলতে থাকে অপরিচিত এক ছেলের জ্বালাতন। একপর্যায়ে বাবাকে জানাল লাবণী। মেয়ে বড় হচ্ছে, স্কুলে বা পথেঘাটে কখন কোন বিপদ-আপদ হয়, তাই মেয়ের হাতে একটা মোবাইল ফোন দিয়েছিলেন বাবা। বাবার প্রশ্ন, লাবণীর নম্বর অপরিচিত একজন জানল কী করে? মোবাইল ফোনে শুধু মা-বাবার সঙ্গেই কথা বলত না লাবণী, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গেও কথা বলত। তাই তো মাঝে মাঝে গোপনে ১০ টাকা, ২০ টাকা ভরে নিত স্কুলের সামনের দোকান থেকে। ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকেই বখাটের হাতে চলে যায় লাবণীর ফোন নম্বর।
দুটি ঘটনাই এই সময়ের। একুশ শতকে এসে সন্তানদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু তারা ইন্টারনেটে কী করছে? কম্পিউটারে কী দেখছে, আমরা কি তা খেয়াল রাখছি? অনেকেই অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে নিরাপত্তার কথা ভেবে তুলে দিচ্ছেন মোবাইল ফোন। সেই ফোনটাই হয়তো বিপদ ডেকে আনছে ছেলেমেয়েদের। যেখানে প্রাথমিক শ্রেণী থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর বই এখন ই-বুক আকারে ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে প্রযুক্তিবিমুখ করে সন্তানদের বড় করা যাবে না, তবে এ ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হবে অভিভাবকদের।
‘প্রযুক্তির সুবিধার কথাই বেশি বলা হয়, এর যে কিছু নেতিবাচক দিক আছে তা তেমন প্রচার হয় না। হয়তো কয়েকটা মেয়ে গল্প করছে, কমবয়সী একটা ছেলে তাদের ছবি তুলল বা ভিডিও করল। ছেলেটি না বুঝেই হয়তো এটা করছে। শিশুর নামে মোবাইল ফোনের সংযোগ নেওয়াও যায় না। এখানে শিশুদের জন্য বিশেষ সেটও (চাইল্ড সেট) নেই। অভিভাবকেরা হয়তো নিরাপত্তার কথা ভেবে তাদের মোবাইল ফোন দেন। কিন্তু শিশু তা সামলাতে পারে না তাই ১৮ বছর বয়সের আগে তার হাতে মোবাইল ফোন দেওয়া উচিত নয়।’ বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন।
ফেসবুকের একটা সুবিধার কথাও বললেন মাহবুবা নাসরীন। ফেসবুকে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা থাকে। ফলে ফেসবুকে কে কি করছে, তা জানা যায়। তিনি বললেন, ‘ডেস্কটপ হোক বা ল্যাপটপই হোক একটি পরিবারে একটি কম্পিউটার থাকা উচিত। কম্পিউটারটা বাসার এমন জায়গায় থাকবে যেখানে সব সময় সবাই যেতে পারে। ইন্টারনেটে শিশু কী করছে তা চাইলেই অভিভাবকেরা জানতে পারেন। কম্পিউটারেও মা-বাবা ও সন্তানদের আলাদা আলাদা আইডি থাকা ভালো। তাহলে অভিভাবক সেই আইডি দিয়ে কম্পিউটারে কী করা হয়েছে তা জানতে পারবেন।’ এসবের ব্যবহার নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই। তাই এসব বিষয় নিয়ে পরিবারে ও পরিবারের বাইরে আলোচনা হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
২২ মাস বয়সেই নিজের ছেলের হাতে কম্পিউটার তুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তাফা জব্বার। তিনি বললেন, ‘যত দিনে শিশু হাত নাড়াতে পারে, তখনই তাকে কম্পিউটার দেওয়া উচিত।’ তবে এও যোগ করলেন, শিশুর ইন্টারনেট বা কম্পিউটার ব্যবহারে মা-বাবার নির্দেশনার (প্যারেন্টাল গাইডেন্স) দরকার আছে। ‘এটা ভালো, ওটা ভালো না; এটুকু শিশুকে বলে দিতে হবে।’ বাংলাদেশের শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট ইন্টারনেটে নেই বলে মনে করেন মোস্তাফা জব্বার। বললেন, ‘স্থানীয় বিষয়ে এবং মাতৃভাষায় ইন্টারনেটে তেমন বেশি কিছু আমরা এখনো দিতে পারিনি। শিশুরা স্থবির নয়, প্রতি মুহূর্তে তাদের চলতে হয়। তাই ইন্টারনেটে মাতৃভাষায় তাদের উপযাগী প্রচুর কনটেন্ট তৈরি করে রাখতে হবে।’
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী কেউ মোবাইল ফোনের সংযোগ নিতে পারে না। সংযোগ নিতে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ আরও কিছু কাগজপত্র লাগে, যাতে বয়সটা বোঝা যায়। তবে কোনো কোনো মা-বাবা নিজেদের নামে সংযোগ নিয়ে সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেন। কিন্তু ১৮ বছর বয়সের আগে কোনোভাবেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন গ্রামীণফোনের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা কাজী মনিরুল কবীর। তিনি বলেন, সন্তান কোথায় আছে বা যেখানে আছে সেখানে পুরোপুরি নিরাপদ নয়—এমন কিছু চিন্তা থেকে অভিভাবকেরা হয়তো তাদের মোবাইল ফোন দেন। এটা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে স্কুলের ভূমিকা আছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবকেরা মিলে এ বিষয়ে দরকারি ব্যবস্থা নিতে পারে। যাতে সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হতে না হয়।
মনিরুল কবীর জানালেন, বিদেশে ছোট্ট বাচ্চাকেও পাশের ঘরে রাখা হয়। সেই ঘরে ট্রান্সমিটার থাকে, বাচ্চা কেঁদে উঠলেই মা-বাবার ঘরে সংকেত বাজতে থাকে। এসব ‘মেশিন টু মেশিন’ প্রযুক্তির ব্যবস্থা থাকা ভালো। আর এ প্রযুক্তি মোবাইল ফোন নির্ভর। আবার বাচ্চার কাছে একটা যন্ত্র থাকতে পারে, বিপদে বা জরুরি অবস্থায় তার বোতাম টিপলেই মা-বাবার মোবাইল ফোনে কল বা বার্তা চলে আসবে। বাচ্চার কাছে থাকা যন্ত্রে একটা সিমকার্ড থাকবে সেটিই নির্দিষ্ট মোবাইল ফোনে জরুরি প্রয়োজনে বার্তা পাঠাবে। এসব ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন খুব কার্যকর হয়ে ওঠে। অভিভাবক, স্কুল ও মোবাইল ফোন সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে নিরাপত্তার কথা ভেবে এমন উদ্যোগ নিতে পারে আমাদের দেশেও।‘শুধু কথা বলার জন্য শিশুর হাতে মোবাইল ফোন দেওয়ার দরকার নেই,’ বললেন মনিরুল।
শিশুদের হাতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মোবাইল ফোন দেওয়া বেশ ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে বর্তমান সময়ে, বললেন ঢাকার মিরপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক রবার্ট টমাস কস্তা। তিনি জানান, ‘স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল ফোন দেওয়া উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে উদ্যোগটা নিতে হবে আমাদের, মানে স্কুল কর্তৃপক্ষের।’ তিনি বললেন, ‘হলিক্রস স্কুলে খোলা জায়গায় একটা টেলিফোন আছে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা তা ব্যবহার করতে পারে। শহরের প্রতিটি স্কুলেই এমন ব্যবস্থা থাকা দরকার।’ তিনি যোগ করেন, ‘দরকার যদি হয় তবে অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে একটু-আধটু ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোনে বেশি সময় দিলে শিক্ষার্থীর মৌলিক লক্ষ্য নষ্ট হয়ে যায়।’
‘মোটামুটি তিন বছর থেকে শিশুরা এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী’—বললেন আইএসপি অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি সুমন আহমেদ। সব বয়সীদের উপযোগী বিষয়বস্তু ইন্টারনেটে রয়েছে। তাই অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার এবং ইন্টারনেট বিষয়টাকে পুরোপুরি বোঝার পরামর্শ দিলেন তিনি। বললেন, ‘কম্পিউটারটা অবশ্যই বাসার খোলা জায়গা বা কমন স্পেসে থাকা উচিত। কিছু বিষয় ইন্টারনেটে আছে যেগুলো আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে মেলে না। তাই মা-বাবাকে দেখতে হবে সন্তান ইন্টারনেটে কী কী ব্যবহার করে। শিশুরা যাতে চাইলে বা ভুল করে তাদের অনুপযোগী কোনো কিছু দেখতে না পারে সে জন্য স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা রাখা যায়। ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার, ফায়ারফক্স, অপেরা, গুগল ক্রোম-ওয়েবসাইট দেখার সব সফটওয়্যারের (ব্রাউজার) জন্যই কিছু ফিল্টারিং প্রোগ্রাম পাওয়া যায়। সেগুলো ব্রাউজারে ইনস্টল করে দিলে শিশুর জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছুই আর খুলবে না। এক্ষেত্রে কম্পিউটার বিক্রেতা, ইন্টারনেট সংযোগদাতা বা ইন্টারনেটে দক্ষ এমন কারও সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।’ যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণই কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত। ‘আসল কথা হলো শিশুকে সময় দিতে হবে অভিভাবকদের। আর ইন্টারনেটে সে কী করছে সে ব্যাপারে খেয়াল করতে হবে।’
১১ আর ১৫ বছরের দুই সন্তানের মা রেজিনা আক্তার। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির প্রধান গ্রন্থাগারিক এই মা বললেন, ‘দুনিয়াটা এখন খোলা। প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না দিলে শিশুকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাই তাকে কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিতে হবে। তবে সে ব্যাপারে অবশ্যই মা-বাবার জানা থাকা দরকার। আবার ওরা যেন বুঝতে না পারে যে, ওদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। ৫, ১০, ১২, ১৪ বিভিন্ন বয়সী শিশুদের উপযোগী বিষয় আছে ইন্টারনেটে। সেগুলো তাদের দেখিয়ে দিলে তারা সেসব ব্যবহার করতে পারবে। তবে উচ্চমাধ্যমিকের আগে মোবাইল ফোন শিশুকে দেওয়ার কোনো যুক্তিই নেই।’
ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিশু নিজের জানাশোনার পরিধি বাড়াবে, এটাই সবাই চান। এই সময়ে এসে প্রযুক্তিকে সন্তানের জ্ঞানের বিকাশে ব্যবহার করতে চাইবেন না কে? সবাই চাইবেন। তবে সঠিকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার না হলে তা লাভ তো দূরের কথা আদরের সন্তানের জন্য ক্ষতিই ডেকে আনবে। তাই সচেতন হতে হবে অভিভাবককেই।

লক্ষ করুন
 ১৮ বছর বয়সের আগে মোবাইল ফোন নয়। এমনিতেই এটা বেআইনি।
 নিরাপত্তার জন্য অভিভাবকেরা স্কুলের সঙ্গে কথা বলে নিতে পারেন।
 প্রয়োজন হলে সন্তানকে নিজের সামনে রেখে মোবাইল ফোনে কথা বলতে দিন।
 বাসার ল্যান্ডফোন থাকবে খোলা জায়গায়।
 কম্পিউটার বাসার খোলা জায়গায় রাখতে হবে।
 দিনে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা সন্তানকে কম্পিউটার ব্যবহার করতে দিন।
 এক বাসায় একটির বেশি কম্পিউটার নয়।
 গুগল বা ইয়াহুর মতো সার্চ ইঞ্জিনে ‘সেফ সার্চ’ সুবিধা সক্রিয় রাখুন।
 ইন্টারনেটে শিশুদের জন্য ফিল্টারিং প্রোগ্রাম রাখা যেতে পারে। যেমন ফায়ারফক্সের জন্য ডব্লিউওটি।
 উইন্ডোজে চলা কম্পিউটারের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের জন্য আলাদা আলাদা ‘ইউজার আইডি’ দিন, যাতে কোন আইডি থেকে কম্পিউটারে কী করা হলো তা পরে জানা যায়।
 সন্তান ইন্টারনেট ব্যবহারের পর ব্রাউজারের ‘হিস্ট্রি’ দেখুন। এতে বোঝা যাবে সে কোন কোন ওয়েবসাইট দেখেছে।
 শিশুকে পড়াশোনা ও জ্ঞান বিকাশে সহায়ক ওয়েবসাইটগুলো দেখিয়ে দিন।
 মজার ও শিক্ষামূলক ওয়েবসাইটের ঠিকানা শিশুকে দিতে পারেন।

0 comments:

Post a Comment