RSS

Sunday, November 28, 2010

সবুজে নির্জনে

অকস্মাৎ নীরবতা। কারও যেন আর কিছু কইবার নেই। চারপাশ কী দারুণ নীরব নিস্তব্ধ! এমনকি পুরো পথ সরব ছিল যে পথপ্রদর্শক তরুণ, তার মুখেও রা নেই। অতি অসাধারণ কোনো দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে হুট করে চুপ হয়ে যাওয়াটাই সম্ভবত নিয়ম। চালক স্পিডবোটের গতি কমিয়ে এনেছে কোন ফাঁকে। আমরা চোখ দিয়ে গিলছি চারপাশের অবিশ্বাস্য সুন্দর। দূরে ওই উঁচুতে উঁকি দিচ্ছে ঘন সবুজ পাহাড়ের সারি। কুয়াশার মতো মেঘ ভর করে আছে পাহাড়ের মাথায়। নিচ দিয়ে বয়ে গেছে সারি নদীর অপরূপ জলরাশি।

জলের রং অদ্ভুত সবুজ। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি পাহাড়ের শরীর বেয়ে সদ্য নেমে আসা সুশীতল জল। পথপ্রদর্শক মনে করিয়ে দেয় সামনেই ভারত-সীমান্ত। এবার ফিরতে হবে আমাদের। স্পিডবোট উল্টোমুখী হয়। একবারের দেখায় আশ মেটে না। পেছন ফিরে বারবার দেখি—অপস্রিয়মাণ শ্বাসরুদ্ধকর সুন্দর। সারি নদীর তীরে একটা টিলার মাথায় নাজিমগড় রিসোর্টের নিজস্ব ক্যাম্প। জায়গাটার নাম লালাখাল। ঘণ্টা খানেকের স্পিডবোট বিহার শেষে আমরা লালাখাল এসে একটু জিরোই। মধ্যাহ্নভোজের বিরতি শেষে ট্রেকিং। সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি। আর জুতমতো কোনো টিলা পেলে তরতরিয়ে উঠে যাওয়া। টিলার মাথায় গিয়ে দাঁড়ালে—তার সমস্ত রূপ-শোভা নিয়ে পুরোদমে জেগে ওঠে লালাখাল। বিকেল বেলাটা ছিল সারি নদীতে কায়াকিংয়ের (খুদে নৌকা চালনা) জন্য বরাদ্দ। লাইফ জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বৈঠা হাতে নেমে পড়া, ব্যস! স্ত্রী রুহিনা তাসকিনের বড় ধরনের জলভীতি আছে। পয়লা প্রস্তাবে বেশ খানিকক্ষণ ‘না না’ করে শেষ অবধি সেও জুটে গেল শৌখিন মাঝিদের দলে। কায়াকিংয়ের মজা একবার পেয়ে গেলে সন্ধ্যার আগে উঠে আসতে কারই বা মন চায়?
যাত্রার শুরু হয়েছিল সিলেট নাজিমগড় রিসোর্ট থেকে। সেই ভোরবেলায় হুমায়ুন রশীদ চত্বর থেকে আমাদের নিয়ে গিয়েছিল নাজিমগড়ের নিজস্ব গাড়ি। সিলেট শহর থেকে মোটে মিনিট দশেকের রাস্তা। দুপুরবেলায় সুইমিংপুলে ইচ্ছেমতো ঝাঁপাঝাঁপি আর হিলটপ রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া শেষে মিলল চারপাশ দেখার সুযোগ। পুরো ছয় একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে নাজিমগড়। সুবিশাল সম্মেলনকক্ষ, জাকুজি, স্টিম বাথ, স্যনা, ব্যায়ামাগার—এসবের কথা নাই বা বললাম। নাজিমগড়ের আসল ঐশ্বর্য লুকানো আছে চারপাশের প্রকৃতিতে। পুরো নাজিমগড়কে ছায়াময় করে রেখেছে বুনো বাঁশঝাড় আর রাজ্যের গাছগাছালি। সকালবেলা বারান্দায় গিয়ে বসলে দূরের বাঁশবাগান থেকে ভেসে আসবে শত পাখির কলরব। এদিক-ওদিক একটু পা চালালেই চোখে পড়বে পদ্মপুকুর। আর সিলেটের চিরায়ত আকর্ষণ চা-বাগান গাড়িতে মোটে মিনিট দশেকের পথ।
প্রথম দিনটা চা-বাগান আর আশপাশ ঘুরে কাটিয়ে দ্বিতীয় দিন একদম সক্কাল-সক্কাল জাফলংয়ের পথে রওনা। যাওয়ার পথে উপরি হিসেবে মিলল ইচ্ছেমতন দূর পাহাড়ের সারি দেখে চোখ জুড়ানোর সুযোগ। তামাবিল সীমান্ত দর্শন শেষে গেলাম নদীর ওপার। সেখান থেকে ভটভটিতে চেপে খাসিয়া পুঞ্জি। খাসিয়াদের বাড়িঘর, পান-সুপারির আবাদ দেখে ফেরার পথে মিলল বিশাল এক হাতির দেখা। শুঁড় উঁচিয়ে, ইয়া বড় কান ঝাঁকিয়ে আমাদের নাকি সেলাম ঠুকল হাতিটা। চারপাশের মানুষজনের ভাব দেখে বুঝলাম, চলতি পথে হস্তি দর্শন এখানে স্রেফ মামুলি ঘটনা। এই খাসিয়া পুঞ্জি ঘোরা শেষেই যাত্রা শুরু হয়েছিল লালাখালের পথে।
‘বিদেশের চেয়ে মোটেও কম কিছু নেই আমাদের। আমাদের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য বিদেশের বহু দর্শনীয় জায়গাকে হার মানাতে পারে। দেশেই যদি লালাখালের মতো এমন অসাধারণ জায়গা থাকে, তবে আর কেন মিছেমিছি ছুটি কাটাতে বিদেশে যাওয়া?’ বলছিলেন নাজিমগড়ের স্রষ্টা, সাবেক ছাত্রনেতা নাজিম কামরান চৌধুরী। গোটা উত্তর সিলেটকে ভুবনমোহিনী এক পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন তাঁর চোখেমুখে। আর এই কাজটা তিনি করতে চান চারপাশের পরিবেশ-প্রকৃতি অটুট রেখেই।
যোগাযোগ—
ওয়েব: www.nazimgarh.com
ফোন: ০১৭১২০২৭৭২২

0 comments:

Post a Comment