RSS

Monday, October 10, 2011

মা-বাবার আবার বিয়ে

বিচ্ছেদ কিংবা মৃত্যু। প্রিয়জনকে হারিয়ে জীবন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে। তবু থেমে থাকে না জীবন। চলে যায় অমোঘ নিয়মে। এই চলার পথেই হয়তো প্রয়োজন পড়ে নতুন সঙ্গীর। অনেকেই এ সময় সন্তানের কথা ভেবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। সন্তান, নাকি নিজের জীবন—কোনটা প্রাধান্য দেবেন। নতুন সঙ্গীকে সব সময় মেনে নিতে পারে না সন্তান। আর সেখান থেকেই শুরু হয় তার মানসিক টানাপোড়েন।

ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা। এসব পরিস্থিতি অনেকটা এড়ানো সম্ভব, যদি শুরুতেই বিষয়টি সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা যায়। এ ক্ষেত্রে সন্তানের সিদ্ধান্তকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের বলেন, ‘মানুষের এসব সম্পর্কের জায়গা বেশ জটিল। মনোজগতে নানা ধরনের আলোড়ন চলতে থাকে। এ সমাজে বাবার আবার বিয়ে যদিও বা সন্তানদের কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে এখনো অপ্রত্যাশিতই। একজন মানুষ একা হয়তো তার জীবন পাড়ি দিতে পারে। তবে তার চলার পথে বন্ধু বা একজন সঙ্গী থাকলে ক্লান্তি ভর করে না।
সমাজেরও এটি মনে করা অন্যায় যে সঙ্গীবিহীন অবস্থায় মানুষটিকে থাকতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, স্ত্রী থাকা অবস্থায় বা তাকে না জানিয়ে বিয়ে করলে সেটি কিন্তু দণ্ডনীয় অপরাধ।অনেক সময় স্ত্রীর মৃত্যু বা বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানকে না জানিয়ে হুট করে সংসারে নতুন সঙ্গী নিয়ে আসেন অনেকে। এটি সন্তানের মনোজগতে প্রভাব ফেলে। আকস্মিক এই আঘাত সে মেনে নিতে পারে না। পারিবারিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা যদি আগেই সন্তানের সঙ্গে পুরো বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করে নেন, তাহলে পরে সমস্যায় পড়তে হবে না। সন্তানের ওপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে না দিয়ে তাকে সময় দিতে হবে। আর এসব বিষয়ে বড়দের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। ধৈর্য হারালে চলবে না।’
প্রায় ২০ বছর আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেন আফসার আহমেদ (ছদ্মনাম)। তাঁর স্ত্রী মারা যাওয়ার সময় তাঁদের ছেলেটির বয়স ছিল আট বছর। পারিবারিক চাপে আবার বিয়েতে সম্মতি দেন। তাঁর নতুন সঙ্গীরও এটি দ্বিতীয় বিয়ে। তাঁরও একটি মেয়ে ছিল। বাবার বিয়ের কথা অন্যদের মুখে শুনে আফসার আহমেদের ছেলেটি তাঁর থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। তিনিও নিজের বিয়ের কথা সন্তানকে সরাসরি বলতে পারেননি। ‘ভেবেছিলাম, ও তো ছোট, তেমন কোনো সমস্যা হবে না। সে সময় সবাই এমনটাই বলেছিল। কিন্তু ছেলেটি কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বোঝাপড়া ভালো হলো না তার। স্ত্রীও তার মেয়েটিকেই বেশি যত্নআত্তি করত। বড় হওয়ার পর ছেলেটি আমাকে ছেড়ে চলে যায়। ওকে আসলে বুঝতে পারিনি আমি। ওর অভিমান বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।’ বলেন তিনি।
প্রাপ্তবয়স্ক বা ছোট বয়সের কোনো সন্তানই শুরুতে তার মা-বাবার স্থানে অন্য কাউকে দেখতে পছন্দ করে না। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাই মা-বাবাকেই এগিয়ে আসতে হবে, কোনোভাবেই সন্তান যেন মানসিক চাপ বোধ না করে। অভিনয়শিল্পী রোকেয়া প্রাচী বলেন, ‘সন্তানকে বোঝাতে হবে, এ বিষয়ে সে-ই মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সব। নতুন সঙ্গীর সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরুতে তাকে সব বুঝিয়ে বলুন। সন্তানের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিন। আপনার সন্তানের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া ভালো হলে বা বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। বিয়ের পর মা-বাবার উচিত সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। আগের মতো পারিবারিক আবহ বজায় রাখতে হবে। নতুন বাড়িতে উঠলে সেটিতে সে যেন পুরোনো পরিবেশ খুঁজে পায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। হুট করেই তার আগের সব অভ্যাস পরিবর্তনের কথা বলা যাবে না। কেননা, শিশুটির হয়তো মা-বাবার সঙ্গে ঘুমানোর অভ্যাস। তাকে যদি আলাদা ঘরে থাকতে বলা হয়, তখন সে ভাববে, নতুন মানুষটির কারণে তার সব হারাতে হচ্ছে। সন্তানের সীমাবদ্ধতা, পছন্দ-অপছন্দ—সব আগেই নতুন সঙ্গীকে জানিয়ে দিতে হবে। যদি দুই পক্ষেরই আগের সন্তান থাকে, তাহলে যথেষ্ট সহনশীল হওয়া উচিত। কোনো ভেদাভেদ করা যাবে না। তাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হলে এর মধ্যে মা-বাবার প্রবেশ না করাই ভালো। খুব ভালো হয় বিয়ের আগেই একে অপরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে। এমনকি বিয়ের দিনও কৌশলী হতে হবে, যাতে সন্তান মনে করে সে-ই সবচেয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে এবং সে একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক। আসল কথা হলো, সে যেন বুঝতে পারে এই সম্পর্ক তার জীবনে নানা প্রাপ্তি যোগ করছে। বিনিময়ে কিছুই হারাতে হচ্ছে না তাকে। তাহলে পরিবারে সুখ-শান্তি থাকবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন মনে করেন, নতুন সঙ্গীটিকে সন্তানের কাছে আস্থাভাজন হতে হবে। এমন কোনো আচরণ করা চলবে না, যাতে সন্তানেরা ভুল বোঝে। তার কথাবার্তা, আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে সন্তানের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে হবে। তাহলে দেখা যাবে, সব দ্বিধা কাটিয়ে সন্তানেরা ঠিকই তাকে আপন করে নিচ্ছে। মা-বাবার বিয়ের পর সন্তান যেন নিজেকে বাইরের কেউ মনে না করে। শিশুর মনস্তত্ত্ব মা-বাবাই সবচেয়ে ভালো বোঝেন। তবু এ সময় বাড়তি যত্ন নিতে হবে। আগের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে তাঁদের। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরও শুরুতে মা-বাবাকে ভুল বোঝা উচিত নয়। মনে কোনো প্রশ্ন না রেখে সরাসরি কথা বললে সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে না।

0 comments:

Post a Comment