RSS

Thursday, June 16, 2011

বাবা কখনোই কোনো কিছু চাপিয়ে দেননি

মেয়েটা সারা দিন মহা আনন্দে আছে। অপেক্ষা করছে বাবার জন্য। পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে, বাবাকে দেখিয়ে তবেই তার শান্তি। বাবা ফিরলেন সন্ধ্যার পর। মেয়ে অসীম আগ্রহে বাবার হাতে ধরিয়ে দিল রিপোর্ট কার্ড। বাবা দেখলেন মনোযোগ দিয়ে। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আরও ভালো করতে পারতে।’
কিংবা ছেলেটা ক্রিকেট খেলায় পর পর দুই বলে দুটি ছক্কা মেরে মহা উত্তেজিত! বাবাকে এল সে সংবাদ দিতে।
বাবা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘আরে! এই তো সেদিন যুবরাজ সিং এক ওভারে ছয়টা ছয় মেরেছে। তুমিও ওভারে ছয়টা ছয় মেরে তারপর কথা বলতে এসো।’
বাবার কাছে সন্তান চায় নির্ভরতা। সন্তানদের দিকে বাবার একটু নজর, তাদের কথাবার্তার বন্ধু হয়ে মিশে যাওয়া, তাদের কাজের ক্ষেত্রে পরামর্শ দেওয়া—সন্তানের মনে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। আর যদি উল্টো হয়, অর্থাৎ বাবার তিরস্কারে যদি বেড়ে ওঠে সন্তান, তাহলে সে আত্মবিশ্বাসী হতে পারে না আর। ফলে গড়ে ওঠে না ব্যক্তিত্ব।
মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটা জন্মের আগে থেকেই। সন্তান যখন গর্ভে বেড়ে উঠছে, তখনই মায়ের শরীরে ও অনুভবে সন্তানের অস্তিত্ব। বাবা কিন্তু ধীরে ধীরে সন্তানের কাছাকাছি হন। এমনকি কোনো কোনো বাবা জন্মের পর সন্তানের প্রতি রুষ্টও হন, স্ত্রীর ভালোবাসা ভাগ হয়ে যাচ্ছে বলে। রাতে যদি সে শিশু কাঁদে, বাবা তাকে কোলে না নিয়ে গলায় বিরক্তি ঢেলে দিয়ে মাকে বলেন, ‘ওকে সামলাও তো! কানটা ঝালাপালা করে দিল!’
এই শিশুই প্রকৃতির নিয়মে একসময় বাবার কাছাকাছি হয়। বিশেষ করে বেড়ে ওঠা, কাজ বেছে নেওয়ার সময়টাতে বাবার সঙ্গ, বাবার পরামর্শ সন্তানের জীবনের ইতিবাচক গুণাবলিকে প্রগাঢ় করে। শিক্ষক, আত্মীয়, বন্ধুদের কাছ থেকে নেওয়া পরামর্শও কাজে লাগে, কিন্তু এ সময় সন্তানের প্রতি বাবার দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক হলে সন্তান নির্ভরতা পায় না। অনেক বাবাই সন্তানের প্রতি এ দায়িত্বটি পালন করতে পারেন না। কাজের চাপে, রুটিরুজির চিন্তায়, সংসার সামলে বাবা সন্তানের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন কম। সন্তান আগ্রহ নিয়ে কিছু বলল, বাবা একেবারেই পাত্তা দিলেন না। বাবা বুঝতেও পারলেন না, এই একটু অবহেলা সন্তানের মনকে করে তুলছে বিষণ্ন, কাজকে করে তুলছে স্থবির। তার উৎসাহে পড়ছে ভাটা। সন্তানের জন্য বাবা কতটা দরকারি, তা বাবা নিজেই বোঝেন না। যখন বুঝতে পারেন, তখন হয়তো দেরি হয়ে যায়, সন্তানদের সঙ্গে মনের বন্ধন শিথিল হয়ে যায়।
কিন্তু সন্তানের পড়ার বিষয় বা পেশা বেছে নেওয়ার সময়টাতে বাবার পরামর্শ খুবই দরকার।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংসদ আসাদুজ্জামান নূরকে বাবা-সন্তানের সম্পর্কের কথাটি জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘সন্তানের প্রতি অর্থবহ সময় আমি হয়তো ততটা দিতে পারিনি। এর প্রধান কারণ, আমার জীবনধারা। এত ব্যস্ত হয়ে আমাকে কাটাতে হয়েছে জীবন, খুব কম সময় পেয়েছি সন্তানদের জন্য। তবে যতটুকু সময় পেয়েছি, সন্তানদের বোঝাতে চেয়েছি, মেধা-প্রতিভা যা-ই থাকুক, পরিশ্রম না করলে জীবন অর্থবহ হবে না। আমি শ্রমিকের মতোই কাজ করেছি। দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেছি। আমার দুই সন্তান সুদীপ্ত ও সুপ্রভাও যথেষ্ট পরিশ্রমী। আমি চেষ্টা করেছি ওদের মনোজগৎটা গড়ে দিতে। আমার নিজের পড়ার অভ্যাস আছে। যখন নিজের জন্য বই কিনতাম, ওদের জন্যও কিনে দিয়েছি। বৃহস্পতিবার রাতে সবাই মিলে ছবি দেখেছি, তাতে ওরা ভালো-মন্দ ছবির পার্থক্য বুঝতে পেরেছে। আমার ছেলে-মেয়ে কখনোই হিন্দি সিরিয়ালের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। সুযোগ পেলেই বেড়াতে গেছি। ওদের ক্যারিয়ার গড়ার পেছনে সরাসরি আমার অবদান নেই। কিন্তু আমাদের জীবনধারা দেখেই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে কে কী পড়বে। সুদীপ্ত কিছুকাল ডেইলি স্টার-এ কাজ করে এখন এশিয়াটিকে কাজ করছে। ভালোই করছে। সুপ্রভা পড়ছে অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে।’
সুদীপ্তকে বলি, কেমন বাবা আসাদুজ্জামান নূর? সুদীপ্ত আরিকুজ্জামান নিজেই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া শিখেছেন বাবার কাছ থেকে। তবে বড় কোনো সিদ্ধান্ত হলে অবশ্যই বাবার সঙ্গে পরামর্শ করেন। বললেন, ‘বাবা খুবই ব্যস্ত, তা সত্ত্বেও তিনি অনেক সময় দিয়েছেন আমাদের। বাবার সঙ্গে একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমাদের। বাবা কোনো দিন কোনো বিষয় আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাননি।’
সুপ্রভা পড়েন বাইরের দেশে। তাঁর সঙ্গে কথা হয় ই-মেইলে। সুপ্রভা তাসনীম বলছেন, ‘বাবা হিসেবে আসাদুজ্জামান নূরের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, তিনি জীবনের যে পথ অনুসরণ করেছেন মঞ্চে, ব্যবসায়, রাজনীতিতে—সব ক্ষেত্রেই তাঁর নিজের কর্ম ও অর্জন দিয়ে আমাদের মধ্যে পরিশ্রম ও চেষ্টার মাধ্যমে দায়িত্ববোধ গড়ে তুলেছেন। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিষয় খারাপ লাগে কিংবা এ ধরনের পড়াশোনায় ক্লান্ত লাগে, তখন বাবার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের সঙ্গে তা তুলনা করে দেখি। সে তুলনায় আমরা কোনোই খাটাখাটনি করি না। ব্যস্ত বাবা বাড়ি ফিরে বাংলা বা ইংরেজি গল্প-কবিতা পড়ে শোনাতেন। আমাদের জীবনে এই শিক্ষা খুব প্রভাব ফেলেছে। তা ছা্ড়া গান-বাজনা, নাটক, বিতর্ক, খেলাধুলা, এমনকি কারাতেও শিখতে পেরেছি বাবার উৎসাহে। বাবাকে সত্যিই আমি বন্ধু মনে করি। বাবা কখনোই চাপ দিয়ে বলেননি, “মেডিকেল পড়ো কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো।” শুধু বলেছেন, আমরা যেন দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তাহলেই মা-বাবা আমাদের এক শ ভাগ সমর্থন দেবেন। তাঁরা তা দিয়েছেনও।’

0 comments:

Post a Comment